কালীমূর্তি বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অথবা গাঢ় নীল বর্ণ। কিন্তু, দেবী রাজবল্লভীর মূর্তি একেবারেই তেমন নয়। তাঁর চারটি হাতও নেই। সাধারণ মানুষের মতোই মাত্র দুটি হাত।
ট্রেনে করে হাওড়া-তারকেশ্বর লাইনে হরিপাল স্টেশনে এসে বাস ধরে সোজা চলে যেতে পারবেন রাজবলহাটে। এই গ্রামেই রয়েছে মা রাজবল্লভীর মন্দির। কালীমূর্তি বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অথবা গাঢ় নীল বর্ণ। কিন্তু, দেবী রাজবল্লভীর মূর্তি একেবারেই তেমন নয়। তাঁর গায়ের রং জ্যোৎস্নার মতো শুভ্র এবং উজ্জ্বল।
প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার মূর্তিটি বিবসনা নয়, চারটি হাতও নেই। সাধারণ মানুষের মতোই দেবীর দুটি হাত। তাঁর জিভও বহির্গত নয়। মুখগহ্বর থাকে বন্ধ। দেবীর পরনে স্থানীয় তাঁতিদের বোনা শাড়ি। দুটি হাতের একটিতে ছুরি, অন্যটিতে রুধির পাত্র। পায়ের নিচে একটি নয়, বরং দুটি শিবমূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। ডান পা থাকে কালভৈরবের বুকের ওপর, বাঁ পা থাকে বিরূপাক্ষ শিবের মাথার ওপর।
-
লোকমুখে প্রচলিত আছে, বহুকাল আগে যখন এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে কংসাবতী নদী বয়ে যেত, তখনই এক সদাগর দেবীর দেখা পেয়েছিলেন। তিনিই এখানে মন্দির তৈরি করেন। তবে সে নিছক লোককথা। ইতিহাসেও রাজবল্লভী মায়ের মন্দির নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন, আনুমানিক ১২৪২ সালে ভূরসুটের রাজা সদানন্দ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। আবার অনেকের মতে, মন্দিরের বয়স ততটা পুরনো নয়। বরং ষোড়শ শতকে রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় নির্মাণ করেছিলেন এই মন্দির।
তবে, ভক্তরা মনে করেন, রাজবল্লভী মায়ের পুজোর ইতিহাস সম্ভবত আরও অনেক প্রাচীন। একসময় এই অঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস ছিল। তাঁদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের বেশ প্রসারও ঘটেছিল। সম্ভবত তখন থেকেই এখানে চলে আসছে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে পূজার্চনা। দেবীর সঙ্গে এখানে পূজা পান নীল সরস্বতী এবং মা তারা-ও। এঁরা দুজনেও বৌদ্ধ দেবী। আবার, দুই পুরুষ অবতারের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়ানো শক্তিমূর্তিটিও বৌদ্ধ দেবী পর্ণশবরীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত অনেক পরে ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পান বলেই দেবীর নাম হয়েছিল রাজবল্লভী।
-
আজও পূজার্চনার রীতিনীতিতে নানা তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ দেখা যায়। নিয়মিত ছাগবলির পাশাপাশি শারদ অষ্টমীতে মেষ বলির রীতি এখানে প্রচলিত আছে। ছাগল বলি দেওয়া অবশ্য হাঁড়িকাঠে মাথা রেখে করানো হয় না। বরং ছাগলটিকে ঝুলিয়ে রেখে প্যাঁচ দিয়ে তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। বলির পর গর্ভগৃহের পিছনের খপ্পরে পশুদের দেহাংশ ফেলে রাখা হয়। শোনা যায় এই খপ্পরের জায়গাটিতেই একসময় ছিল রাজা সদানন্দের পঞ্চমুণ্ডের আসন। এখানে বসে তিনি তন্ত্রসাধনা করতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের সমস্ত প্রাচীন নিদর্শনই হারিয়ে গিয়েছে। বর্তমান মন্দিরের বয়স একশো বছরের বেশি নয়।
মা রাজবল্লভীর স্বভাব সম্পর্কেও বজায় রয়েছে রাজকীয়তা। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, প্রত্যেক রাত্রে বিরাট কাঠের পালঙ্কে নিদ্রা যান দেবী। মাঝেমধ্যে রাত্রিবেলা তাঁর তামাক সেবনের ইচ্ছাও জাগে। তাঁর জন্য, মন্দিরের এক কোণে প্রস্তুত রাখা থাকে গড়গড়া। তবে, খাবার খাওয়ার বিষয়ে তাঁর খুব-বেশি আড়ম্বর নেই। কোনওরকম সম্বরা না দিয়ে প্রত্যেকদিন সিদ্ধ ভোগ রান্না হয় মায়ের জন্য, মন্দিরের লাগোয়া রন্ধনশালায় হওয়া রান্না প্রত্যেকদিন প্রচুর ভক্তদের হাতে পরিবেশন করা হয়।
-