সংক্ষিপ্ত


বড়ে গুলাম আলি খানের (Bade Ghulam Ali Khan) কাছেই নাড়া বেঁধেছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায় (Sandhya Mukherjee)। এক নজরে দেখে নিন তাঁর সঙ্গীত জীবন। 

বাংলা সুরের জগতের আকাশে অস্তরাগের ছোঁয়া, ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় চলে গেলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায় (Sandhya Mukherjee Passes Away)। ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়ায় (Dhakuria) জন্মেছিলেন তিনি। বাবা নরেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন রেলওয়ে অফিসার, আর মা হেমপ্রভা দেবী ভাল ঠুংরি গাইতেন। পণ্ডিত সন্তোষকুমার বসুর তত্ত্বাবধানে তিনি গানের চর্চা শুরু করলেও, তিনি তাঁর দাদার কাছে আবদার করেছিলেন, গান শিখবেন বড়ে গুলাম আলি খানের (Bade Ghulam Ali Khan) কাছে। সেই মতো তাঁর দাদা, তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের (Gyanprakash Ghosh) বাড়িতে। 

সেখানে উপস্থিত ছিলেন বড়ে গুলাম আলি। এর কিছুদিন পর তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায়কে গানের তালিম দিতে রাজি হয়েছিলেন। শোনা যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায়ের হাতে লাল সুতোর নাড়া বেঁধে, তাঁকে গুড় ছোলা খেতে গিয়েছিলেন। প্রথমে বড়ে গুলাম আলি খান, তারপর তাঁর পুত্র ওস্তাদ মুন্নাওয়ার আলি খান-এর (Ustad Munnawar Ali Khan) কাছ থেকে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। বড়ে গুলাম আলি খান-কে তিনি বাবা বলেই সম্বোধন করতেন। গানের জগতে পাথেয় করে নিয়েছিলেন গুলাম আলির মন্ত্র - 'একটি রাগ সঠিকভাবে গাইতে পারলেই সঙ্গীত জীবন সার্থক হয়'। 

শুধু বড়ে গুলাম আলি নয়, পেয়েছিলেন আরেক সঙ্গীত কিংবদবন্তি বেগম আখতারের (Begum Akhtar) সান্নিধ্য়ও। বেগম আখতার নিজে হাতে তানপুরা বাঁধতে শিখিয়েছিলেন সন্ধ্যাকে। তাঁকে অনেক অনুষ্ঠানে তানপুরায় সঙ্গতও করেছিলেন সন্ধ্যা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নিলেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বেশিরভাগই স্মরণীয় গানই আধুনিক বাংলা গান। তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের লং প্লে রেকর্ড করার স্বপ্ন ছিল তাঁর, যা পূরণ হয়নি। পুজোর গানকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। আর ১৯৪৮ সালে 'কার বাঁশি বাজে' দিয়ে তিনি পুজোর গান শুরু করেছিলেন। তবে, তাঁর প্লেব্যাকের কেরিয়ারের শুরু মুম্বাইয়ে (Mumbai) হিন্দি গান দিয়ে। ১৯৫০ সালে তারানা চলচ্চিত্রের একটি গান করেছিলেন। সেই সময় ১৭ টি হিন্দি ছবিতে গান করেন। 

এরপর, ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন, এবং এই শহরেই থেকে যান। ১৯৬৬ সালে তিনি কবি শ্যামল গুপ্তকে (Shyamal Gupta) বিয়ে করেছিলেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায়ের গাওয়া অনেক গানেরই কথা তাঁর লেখা। তবে, তার সবথেকে জনপ্রিয় গানগুলি ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (Hemanta Mukherjee) সঙ্গে। বাংলা চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক সঙ্গীতে এই জুটির অসংখ্য হিট গান রয়েছে। উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন (Uttam Kumar - Suchitra Sen) জুটির সাফল্যের নেপথ্য়ে হেমন্ত-সন্ধ্যা জুটির কণ্ঠের বড় অবদান ছিল।  এছাড়া, রবিন চট্টোপাধ্যায় () এবং নচিকেতা ঘোষের সঙ্গেও অনেক ভাল ভাল কাজ করেছিলেন তিনি। সিনেমার গানের পাশাপাশি লোকসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুল গীতিও গেয়েছিলেন গীতশ্রী। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের গণআন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজে উৎসর্গ করেছিলেন নিজের শিল্প। বাংলাদেশী সঙ্গীতশিল্পী সমর দাসকে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা করেছিলেন। বাংলাদেশে সম্প্রচার করা এই গোপন রেডিও স্টেশনের জন্য তিনি বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গান রেকর্ডও করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি উপলক্ষে তিনি 'বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে' গানটি প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি কনসার্টে সঙ্গীত পরিবেশনও করেছিলেন।

চলতি বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায়কে পদ্মশ্রীতে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তবে, তিনি এতদিনে এসে এই পুরস্কারটি 'অসম্মানজনক এবং অপমানজনক' বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তবে, ১৯৬৫ সালেই তিনি দীপ শিখা ছবির জন্য, বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর বিচারে সেরা মহিলা প্লেব্যাক গায়িকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে জয় জয়ন্তী ছবির জন্য ফের বিএফজেএ সেরা মহিলা প্লেব্যাক গায়িকার পুরস্কার জেতেন। ১৯৭১ সালে জয় জয়ন্তী ছবির 'আমাদের ছুটি ছুটি' এবং নিশি পদ্ম ছবির 'ওরে সকল সোনা মলিন হোলো' গানের জন্য শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও জিতেছিলেন। ১৯৯৯ সালে তাকে সারা জীবনের অবদানের জন্য ভারত নির্মাণ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার বঙ্গ বিভূষণে ভূষিত করা হয়েছিল।