সংক্ষিপ্ত
- করোনাভাইরাসের আতঙ্কে আতঙ্কিত ডুয়ার্স
- বক্সা-র প্রত্যন্ত এলাকাতেও পড়েছে এর প্রভাব
- এমন সময়ে ড্রুকপাদের ভরসা তাঁদের কালী-মাই
- ড্রুকপারা মনে করে কালী-মাই তাঁদের রক্ষা করবে
ডালিয়া সরকার, প্রতিনিধি- একটা চোখ। একটা হাত। আর রয়েছে একটা পা। ইনি হলেন কালী মাই। বৌদ্ধ ধর্মে বর্ণিত বিপদের রক্ষাকর্তা। এই কালী-মাই-এর এমন শক্তি নাকি তাতে বাগ মেনে যায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এমনই বিশ্বাস ডুর্য়াসের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের বক্সা পাহাড়ের উপরে বসবাসকারী ড্রুকপাদের। আর সেই বিশ্বাসেই রবিবার ভুটান লাগোয়া বক্সা পাহাড়ের উপরে সিঞ্চুলা রেঞ্জে তাদের গ্রামে কালী-মাই-এর আরাধনায় মেতে উঠল ড্রুকপারা।
স্থানীয় বাসিন্দা ফুয়া ড্রুকপা জানালেন, গত বছরও করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে তাঁরা কালী-মাই-এর এমন পুজোর আয়োজন করেছিলেন। এই পুজো খুবই কঠিন এবং ব্যায়সাপেক্ষ। ফলে খুব ঘনঘন এই পুজো করা যায় না। কিন্তু, যেভাবে করোনাভাইরাসের অতিমারি পুরো মনুষ্য সমাজকে আক্রমণ করেছে তাতে এই পুজো না করে উপায়ও নেই বলে জানিয়েছেন ফুয়া। তিনি আরও জানান যে, কালী-মাই-এর পুজোতে সত্যি সত্যি করোনাভাইরাস পালিয়ে যায় কি না তা বিজ্ঞান সম্মতভাবে কেউই বলতে পারবে না। তবে, তাঁদের বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাসে কালী-মাই একজন পরিত্রাতা। আর সেই বিশ্বাসেই সমগ্র ড্রুকপা সমাজের আস্থা রয়েছে। গত বছরও দেখা গিয়েছে, কেউ হয়তো করোনারমতো উপসর্গে আক্রান্ত। কিন্তু, কালী-মাই-এর আশীর্বাদ থাকায় ই উপসর্গ বেশি বাড়াবাড়ি করতে পারেনি বলেই দাবি করেছেন ফুয়া। দেখা গিয়েছে দিন কয়েক প্রবল সর্দি-জ্বর হয়েছে। এরপর সেই আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। ফুয়া আরও জানিয়েছেন যে, ড্রুকপারা বিশ্বাস করেন, আসলে করোনাভাইরাস শরীরে ঢুকলেও কালী-মাই-এর আশীর্বাদে তা সর্দির আকারে শরীর থেকে বেরিয়ে চলে যায়। এবার করোনাভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে আঘাত হেনেছে। ড্রুকপারা বিশ্বাস করছে, যে এবারও কালী-মাই তাঁদের রক্ষা করবে।
বক্সা পাহাড়ের সিঞ্চুলা রেঞ্জে যেখানে ড্রুকপা জনজাতির বাস সেখানে পৌঁছানোর নির্দিষ্ট কোনও রাস্তা নেই। পাহাড়ি ঢাল এবং মাঝে মাঝে কিছু রাস্তার মতো জায়গা দিয়ে সেখানে পৌঁছতে হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ব্লকের বক্সা পাহাড়। এই পাহাড়েই রয়েছে ড্রুকপা জনজাতিদের ছোট-বড় মোট ১৩টি গ্রাম। জনসংখ্যা কম করে হলেও ৫০০০। সেখানে নেই কোন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা । স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলেও কিছুই নেই। করোনার মতো মহামারী যদি থাবা বসায় এই গ্রামে গুলিতে, কি হবে সেই ভেবেই আতঙ্কিত ড্রুকপা সমাজ। যেখানে স্বাধীনতা এতোগুলো বছর পরও গড়ে ওঠেনি নুন্যতম স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। সেখানে করোনার মতো মহামারী থাবা বসালে নিমেষেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে শতাব্দী প্রাচীন এই গ্রমাগুলি এই আশঙ্কায় করছেন স্থানীয় মানুষজন।
তিথি নক্ষত্র দেখে দিন ঠিক করে তবেই কালী-মাই-এর পুজো হয়। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে পুতুল দিয়ে এই পুজোর আয়োজন হয়। পুজো শেষে এই ছেলে পুতুলটিকে শ্মশানের দক্ষিণ পাশে এবং মেয়ে পুতুলটিকে শ্মশানে উত্তর পাশে ফেলে দেওয়া হয়। ড্রুকপাদের বিশ্বাস করোনার মতোন মহামারী এই ছেলে পুতুল এবং এই মেয়ে পুতুল দুটির উপরই তার প্রভাব ফেলতে পারবে। তাদের জনজাতির মানুষের উপরে করোনার কোনো প্রভাব পড়বে না।
ডুয়ার্স মানেই পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে এক উজ্জ্বল স্থান। সেই ডুয়ার্সের বুকেই রয়েছে এই ড্রুকপাদের বাস। পর্যটকদের কাছে ড্রুকপাদের জীবন-যাত্রা এবং বৈচিত্র খুব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনও রাস্তা না থাকায় অনেক পর্যটকই চট করে ড্রুকপাদের গ্রামের দিকে পা বাড়াতে চান না। কিছু পর্যটক রয়েছেন যাঁরা ড্রুকপাদের গ্রামে যান। ডুকপারাও চান যাতে পর্যটকরা তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারেন। করোনা অতিমারির জন্য ডুয়ার্সের পর্যটন খুবই ধাক্কা খেয়েছে। সুতরাং, যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ডুয়ার্সে যাতে পর্যটকদের ভিড় বাড়ে তার আশায় রয়েছেন এখানকার পর্যটন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা চাইছেন, ড্রুকপাদের গ্রামে পৌঁছানোর জন্য যদি ভালো সড়ক যোগাযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে বহু পর্যটক বক্সা-র এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পা রাখতে পারবে।