বলিউডে আইটেম নম্বরে পথ প্রদর্শক হেলেন নায়িকাদেরও ছাড়িয়ে যেতেন
- FB
- TW
- Linkdin
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অকালে মারা যান গৃহকর্তা ডেসমায়ার। তখ্ন তাঁর স্ত্রী অন্ত্বঃসত্ত্বা। দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে রেঙ্গুন ছাড়লেন সেই মা। প্রথমে উদ্বাস্তু দলের সঙ্গে তাঁরা এসে পৌঁছন ডিব্রুগড়ে। সেখান থেকে ঠাঁই হল কলকাতায়। তারপর কলকাতার পাট চুকিয়ে মুম্বই।
তখনও এ দেশ পরাধীন। নার্সের কাজ নিলেন মা। কিন্তু তার সামান্য বেতনে নুন আনার আগেই পান্তা শেষ। সেইসঙ্গে কন্যা সন্তানটির স্কুলের পড়াশোনা। মায়ের পাশে দাঁড়াতে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিল মেয়েটি। কাজ নিল বোম্বাইয়ের সিনেমা পাড়ায়। আরবসাগরের তীরে শুরু হল নতুন করে জীবনযুদ্ধ।
কিন্তু বলার মতো প্রথম ব্রেক ১৯৫৮ সালে ‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবিতে গীতা দত্তের গলায় ‘মেরা নাম চিন চিন চু’। উনিশ বছরের তন্বীর নাচ আইকনিক হয়ে গেল বলিউডে। এরপর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি। বলিউডে হেলেন অ্যান রিচার্ডসন বিখ্যাত হয়ে গেলেন হেলেন নামে।
বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমায় শুরু থেকেই প্রেম বা প্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে আবেগঘন দৃশ্যে অবধারিতভাবে এসেছে যৌনতা। যাকে পুঁজি করে বহুকাল ধরে বলিউড পেয়ে এসেছে ব্যবসায়িক সফলতা।
সে দৃশ্যের উপস্থাপনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসেছে নাচ ও তার সঙ্গে গান এবং শয্যাদৃশ্য। পরিভাষায় তাকে আমরা রগরগে দৃশ্য বললেও সে দৃশ্য বেশিরভাগ দর্শকদের কাছে উপভোগ্য। মূলধারার সিনেমার জনপ্রিয়তার বিচারে একে আমরা অশ্লীল বা অন্য যেভাবেই ভাবি না কেন বলিউডের ছবিতে ওই ধরণের দৃশ্য এসেছে। কখনো ছবির নায়িকা, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে খলনায়িকা কখনও আবার পার্শ্ব নারীচরিত্র ছবিতে যৌনতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন নাচ ও গানের সেই দৃশ্যে।
লক্ষ্যনীয় বলিউডে ত্রিশের দশকে যখন দেবিকা রানি, নিম্মি, কামিনী কৌশল, সুরাইয়ার মতো নায়িকারা ছবির কাহিনি অনুযায়ী সাধারণ প্রেমের চরিত্র হয়েছেন তখনও একজন খলনায়িকা আবির্ভূত বেশ খোলামেলা ভাবে। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে পঞ্চাশের শেষের দিক থেকে ধরণটা বদলায়। নায়ক নায়ীকার প্রেমের মাঝখানে কিংবা খলনায়কের প্রতিনিধি হয়েও খলনায়িকা হাজির হয়েছেন তবে তাঁর আবির্ভাব নাচ ও গানের দৃশ্যে খোলামেলা পোষাকে। বলিউডের সেই সবচেয়ে আবেদনময়ী অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী হলেন হেলেন।
তখনকার বলিউডে মধুবালা ও বৈজয়ন্তিমালার দাপুটে উপস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তবে সিনেমায় একটি গানের নাচে কিংবা ছোট্ট একটি চরিত্রে তিনি যে শরীরি আবেদন রাখতেন তা ওঁদের ভূমিকাকে ছাপিয়ে যেত। কোনওদিনই হেলেন নায়িকা হন নি, ভ্যাম্প বা খলনায়িকা কিংবা ক্যাবারে শিল্পী হিসেবেই তাঁর রুপোলি পর্দায় আগমন এবং প্রস্থান। কিন্তু ওইটুকু ভূমিকাতেই তিনি দর্শক হৃদয় জয় করতেন এবং স্মরণে থাকতেন।
সত্তরের দশকে পর্দায় হেলেনের পাশাপাশি ছিলেন বিন্দু, অরুণা ইরানি, বিনার মতো আরও অনেকে। তবে তাঁরা সবাই পিছনে পরে থাকতেন। কারণ প্রতিটি ছবিতে হেলেনের আবির্ভাব ছিল নতুন নতুন চমক নিয়ে। গানের সঙ্গে হেলেনের অভিব্যক্তি ছিল আবেদনে ভরপুর। সুঅভিনেত্রী নায়িকা থেকে শুরু করে ড্রিম গার্ল হেমা মালিনী তাদের সৌন্দর্যের জন্য আলোচিত হলেও পর্দায় হেলেন একদিকে তাঁর খোলামেলা উপস্থিতির পাশাপাশি তাঁর শরীরী আবেদন দিয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন দর্শকদের।
মণিপুরী, কত্থক এবং ভরতনাট্যমের তালিম নিয়েছিলেন হেলেন। কিন্তু তার আসল মুনসিয়ানা ছিল ক্যাবারে নাচে। তৎকালীন আপাত-নিষিদ্ধ নাচকে রূপালি পর্দায় নানা আঙ্গিকে ব্যবহার করেছিল বলিউড। ‘গুমনাম’, ‘শিকার’, ‘এলান’, ‘লহু কে দো রং’-এর মতো ছবিতে হেলেনের উপস্থিতি দর্শকরা চিরকাল মনা রাখবেন। সেই সঙ্গে যতদিন মূলধারার হিন্দি সিনেমা আলোচনায় আসবে, ততদিন গুঞ্জরিত হবে ‘শোলে’-এর ‘মেহবুবা মেহবুবা’,‘ইন্তেকাম’-এর ‘আ জানে যাঁ’ কিংবা ক্যারাভান-এর ‘পিয়া তু অব তো আ জা’। আশা ভোঁসলের 'পিয়া তু আব তো আজা' গানে হেলেনের অনবদ্য এনার্জেটিক পারফরমেন্সের সঙ্গে কোমর দোলেনি এমন ভারতীয় কমই আছেন। যেমন সুরেলা দমদার গান, তেমনই হেলেনের মোহময়ী নাচ।