- Home
- Entertainment
- Bollywood
- ইউসুফ নাম বদলে হয়েছিল 'দিলীপ কুমার', ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে মহীরূহের সফরনামা
ইউসুফ নাম বদলে হয়েছিল 'দিলীপ কুমার', ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে মহীরূহের সফরনামা
তপন বক্সি, মুম্বই- ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে মহীরূহ পতন। চলে গেলেন দিলীপ কুমার। অবিসংবাদী 'ট্র্যাজেডি কিং' নেই। দিলীপ কুমারের মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হল হিন্দি সিনেমার এক ঐতিহ্যপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায়ের। বিভক্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের পেশোয়ারে 'কিসসা খওয়ানি বাজার'-এ মহম্মদ সারওয়ার খান আর আয়েষা বিবির চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয় ১১ ডিসেম্বর, ১৯২২। নাম মহম্মদ ইউসুফ খান। সন্ধ্যেরাতে জন্ম। সেদিন সেই বাজারের দোকানগুলোয় আগুন লেগেছিল। ডিসেম্বরের শীতের রাতে ভেসে আসা আগুনের হলকার মধ্যে ইউসুফ এর জন্ম হওয়াকে ঠাকুরমা গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছিলেন। প্রবাদপ্রতীম অভিনেতাকে নিয়ে কলম ধরলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক তপন বক্সি ।
| Published : Jul 08 2021, 11:50 AM IST / Updated: Jul 08 2021, 01:23 PM IST
- FB
- TW
- Linkdin
সারওয়ার আর আয়েষার মোট ১২ জন সন্তান-সন্ততি। একদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে বোম্বের উদ্দেশ্যে রওনা হল ফল ব্যবসায়ী সারওয়ারের পরিবার। ইউসুফের বয়স তখন আট কি নয়। সবাই উঠলেন ক্রফোর্ড মার্কেটের কাছে 'আবদুল্লা' বিল্ডিংয়ে। ইউসুফ আর ওঁর দাদা আয়ুবকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল নাসিক জেলার ছোট হিল স্টেশন দেওলালিতে।
ব্রিটিশদের আর্মি স্কুলে পড়াশোনা করে বোম্বে ফিরে ইউসুফ ভর্তি হলেন মাতুঙ্গার খালসা কলেজে। বাবার সঙ্গে মনোমালিন্যে যুবক ইউসুফ চলে গিয়েছিলেন পুনায়। ৩৬ টাকার মাস মাইনেয় আর্মি ক্যান্টিনে ম্যানেজারি করতে।
জীবনের মোড় ঘুরল বোম্বের মালাডে 'বম্বে টকিজ'-এর বাঙালি মালকিন দেবিকারানীর দৌলতে। সেই সময় মাস মাইনেয় কাজ জুটল। পরিচয় হল অশোক কুমার, শশধর মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে। এখানেই প্রথম 'নায়ক' হওয়া। ছবির নাম 'জোয়ার ভাটা'। সাল ১৯৪৪।
দেবিকারানীই ইউসুফের নাম দিলেন 'দিলীপ কুমার '।অশোক কুমারের সঙ্গে মিলিয়ে। ছবিটির পরিচালক ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। দিলীপের বয়স তখন ২১।
পেশোয়ারের খওয়ানি বাজার মহল্লায় বাবার হিন্দু বন্ধু বসেশ্বরনাথের বড় নাতি রাজ কাপুরের সঙ্গে নতুন করে দেখা হয়েছিল মাতুঙ্গার খালসা কলেজে। পরে ঘটনাচক্রে আবার 'বম্বে টকিজ'-এ। রাজ কাপুর তখন 'বম্বে টকিজ'-এ ১৭০ টাকার মাস মাইনেয় চাকরি করছেন।
এরপর পরপর 'প্রতিমা', ' মিলন', 'জুগনু', 'অনোখা প্যায়ার', 'মেলা', 'নদিয়া কে পার', করার পর ১৯৪৮ -এ 'শহীদ' করলেন কামিনী কৌশলের সঙ্গে। সিনেমার অভিনয়ের পেশায় দিলীপের প্রথম ভালোবাসার নাম কামিনী ওরফে উমা কাশ্যপ। উমার বুদ্ধিদীপ্তি দিলীপকে টেনেছিল। ততদিনে দিলীপরা ক্রফোর্ড মার্কেটের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন বান্দ্রার পালিমালার বাংলোয়।
১৯৪৯-এ 'আন্দাজ' করতে গিয়ে রাজ-নার্গিস-দিলীপের একত্র কাজ করা। যে ত্রয়ীকে নিয়ে আজও আলোচনা চলে। এই ত্রিকোণমিতি চলল বেশ কিছুদিন। পরে রাজ-নার্গিস জুটির প্রেমোপাখ্যান আরও নেশাতুর হয়ে ওঠে।
নার্গিসকে রাজের দখলে ছেড়ে দিয়ে দিলীপ আর এক প্রনয়িণীকে পেলেন। মুমতাজ জেহান বেগম। 'মধুবালা'। ১৯৫১-তে দুজনের প্রথম ছবির নাম 'তরানা'। মধুর বাবা আতাউল্লা খান এই দুজনকে নিয়ে প্রযোজক হিসাবে 'মুঘল-ই-আজম' করার সময়েই স্বপ্ন দেখলেন যেন এভাবেই এঁরা দুজন তাঁর প্রোডাকসন কোম্পানিকে আরও উর্বর ও লাভজনক করে তোলেন। প্রমাদ গুণলেন দিলীপ। নিজের আবেগ আর তৃতীয় প্রেমকে আরও একবার বলি দিলেন।
'৫২-'৫৩-য় পালিমালা থেকে সামনেই পালি হিলের নতুন বাংলোয় উঠে এলেন দিলীপরা। মা-বাবা তখন মারা গিয়েছেন। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে মহম্মদ এহসান আর নাসিম বানুর বাংলো। ওঁদের পরমাসুন্দরী মেয়ে সায়রা ফিল্ম অ্যাক্টিংয়ে আসতে চান। তিনি দিলীপ কুমারের ডাই-হার্ড ফ্যান। '৬৬-র ১১ অক্টোবর দিলীপ-সায়রার নিকাহ হল। '৮২-তে হায়দরাবাদে আসমা রেহমানকে নিকাহর ভুল সায়রার কাছে কবুল করেছিলেন দিলীপ। তারপর দিলীপ-সায়রার প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
দিলীপের অভিনয় একসঙ্গে ছ'টা দশককে অতিক্রম করেছে। 'জোয়ার ভাটা' সুপার ফ্লপ ছিল। সমালোচকদের তীরে আক্রান্ত হয়ে নিজেকে নতুন করে গড়তে নেমেছিলেন দিলীপ। শপথ নিয়েছিলেন যেভাবেই হোক যোগ্য হয়ে ফিরবেন আবার। প্রচুর হলিউডের ছবি দেখা শুরু করলেন। আমেরিকান অভিনেতা জেমস স্টিউয়ার্টের ধীর, সহজগতি স্টাইল আর প্রবাদপ্রতিম সুইডিশ- আমেরিকান অভিনেত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যানের ধারাকে অনুসরণ করলেন। নতুন প্রত্যয়, অধ্যবসায় আর একাগ্রতায় ফিরে এলেন দিলীপ। অ্যাক্টিং মেথডকে ঢেলে সাজালেন।
সসমালোচকরাও আশার কথা শোনালেন। 'শহীদ', 'নদিয়া কে পার', 'মেলা', 'শবনম', 'আন্দাজ', 'যোগন', 'বাবুল', 'আরজু' থেকে শুরু করে ' নয়া দৌড় ', 'মুঘল- ই- আজম', ' পয়গম ', 'মধুমতী, 'গঙ্গা যমুনা ', আশার বাণী নিয়ে এল। এমনকি দ্বিতীয় ইনিংসে 'ক্রান্তি', 'বিধাতা', 'শক্তি', 'কর্মা', 'মশাল' বা 'সওদাগর' তাঁর নতুন অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর হয়ে থাকল। নূরজাহান থেকে লীনা চন্দ্রভারকর তিন দশকের নায়িকাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিলীপ রোমান্স করেছেন রুপোলি পর্দায়।
১৯৬১-তে 'গঙ্গা যমুনা' দিলীপের অভিনয় জীবনের মুকুটে অনেকগুলো পালক যোগ করেছিল। জীবনের প্রথম দিকের রোমান্টিক কষ্টের ছবি গুলো দেখে ফিমেল ফ্যানরা যত ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন, প্রযোজকরা ততই লাভের কড়ি ঘরে তুলেছেন।
রাজ কাপুর চ্যাপলিনের অভিনয় ধারাকে রপ্ত করেছিলেন। দেব আনন্দ গ্রেগরি পেকের। দিলীপ সেখানে বেছে নিয়েছিলেন জেমস স্টিউয়ার্ট আর বার্গম্যানকে। দিলীপের ঝিমধরা আবেগ, যন্ত্রণা, ক্লেশ হিন্দি ছবির রোমান্টিক পরিবেশকে অন্যভাবে চিনতে শিখিয়েছে।
লেখা সংলাপের আড়ালে অলিখিত ভাবশিখাকে জ্বালিয়ে তুলে দিলীপ জাদুকরী দৃষ্টি, অভিব্যক্তি আর শুধুমাত্র সংকেতে চরিত্রকে অন্যমাত্রা দিতে পেরেছেন। তাই ওঁর শেষদিকের 'শক্তি' বা 'সওদাগর' -এর চরিত্রগুলোর ওপর দিলীপের দখল, অনুগামিতা, সূক্ষ্ম তারতম্য আর স্তরভেদ চরিত্রগুলোকে একটার সঙ্গে আরেকটায় মিশতে দেয়নি।
দুঃখের বিষয় যে নিজের পরিচালনায় 'কলিঙ্গ' ছবি করার ইচ্ছেটা শেষমেশ অধরাই থেকে গেল। কিম্বা শেষ অভিনীত ছবি 'কিলা' সাধারণ দর্শকদের তেমন নাগাল পেল না। কিন্তু বয়সের শীতলতা কিম্বা প্রতিযোগীদের উত্থান দিলীপের জায়গা কেড়ে নিতে পারেনি। একশো বছর পেরিয়ে যাওয়া ভারতের সিনেম্যাটিক অভিনয়ে যে কমনীয় অভিনয়ধারাকে তিনি পরিচয় করালেন, তা এককথায় অতুলনীয়। তার গুরুত্ব অপরিসীম। এই দেশের সিনেম্যাটিক অভিনয়ে তিনি অমর ও অননুকরণীয় এক চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠান হয়ে রয়ে যাবেন।