সংক্ষিপ্ত
হিন্দুদের যে কোনো কাজেই গঙ্গাজলের প্রয়োজন হত, কি বিবাহ, কি পূজো-আর্চা, কি মৃতের শ্রাদ্ধ। বৈষ্ণবচরণ মুখবন্ধ মাটির হাঁড়িতে গঙ্গাজল সরবরাহ করতেন। শুধু তাই নয় ব্রিটিশরা ভারতের দখল নেওয়ার পর আদালতে বাদী-বিবাদী হিন্দুদের শপথ নেওয়ার ক্ষেত্রেও গঙ্গাজল ব্যবহার করা হত৷
শেঠ বৈষ্ণবচরণের গঙ্গাজল বিক্রি ও ঠাকুরবাড়ির উত্থান ---- সেযুগে শেঠ বৈষ্ণবচরণের ছিল একচেটিয়া গঙ্গাজল বিক্রির ব্যবসা। কিভাবে তাঁর হাত ধরে উত্থান হল ঠাকুরবাড়ির এক আদি পুরুষের লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার ----
ইংরেজরা তখন ধীরেধীরে গড়ে কলকাতাকে (British Ruled Kolkata) গড়ে তুলছে লণ্ডনের (London) আকারে। তৈরি হচ্ছে 'প্রাসাদ নগরী'। সেই সময়ের গল্প। পুরনো কলকাতায় একটি অঞ্চল তখন গাছপালা কেটে প্রস্তুত করার কাজ চলছে। আগে সেখানে একটি বেশ বড় ঝিল ছিল, যে কারণে ওখানে যাওয়া সহজ ছিল না। কলকাতার এক ধনী শেঠ বৈষ্ণবচরণ (Seth Baishnabcharan) ঠিক করলেন সহস্রাধিক মুদ্রা ব্যয় করে দুটি সাঁকো তৈরী করে দেবেন সেই ঝিলের ওপর, একটি ব্রাহ্মণদের জন্যে, অপরটি অন্য জাতির জন্যে। করেও দিলেন। খুব সম্ভবত দুটি সাঁকোকে জোড়া দেওয়ার নাম থেকেই এই 'জোড়াসাঁকো' (Jorasanko)নামটির উৎপত্তি।
এলাকার সব গাছপালা সাফ করে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরী করেন বৈষ্ণবচরণ। কলকাতার পুরনো ইতিহাস (Old History of Kolkata) ঘেঁটে জানা যায়, সম্পূর্ণ জোড়াসাঁকো অঞ্চল তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, ঠাকুরবাড়ির এক আদি পুরুষ নীলমণি ঠাকুর (Nilmani Tagore was the Ancestor of Rabindranath Tagore) ছিলেন তাঁর বেশ প্রিয়পাত্র। বন্ধুকে উপকারের পাশাপাশি ব্রাহ্মণকে জমিদানের পূণ্যের আশায় জোড়াসাঁকোর বেশ বড় একটি এলাকা তিনি নীলমণিকে দান করেন। বৈষ্ণবচরণ যে ব্যবসা করতেন, তার দিকেই ধীরেধীরে আকৃষ্ট হন নীলমণি ।বৈষ্ণবচরণের আর পাঁচটা ব্যবসার মধ্যে একটি ব্যবসা ছিল 'গঙ্গাজলের ব্যবসা'।
হিন্দুদের যে কোনো কাজেই গঙ্গাজলের প্রয়োজন হত, কি বিবাহ, কি পূজো-আর্চা, কি মৃতের শ্রাদ্ধ। বৈষ্ণবচরণ মুখবন্ধ মাটির হাঁড়িতে গঙ্গাজল সরবরাহ করতেন। শুধু তাই নয় ব্রিটিশরা ভারতের দখল নেওয়ার পর আদালতে বাদী-বিবাদী হিন্দুদের শপথ নেওয়ার ক্ষেত্রেও গঙ্গাজল ব্যবহার করা হত৷ অথচ আর্যাবর্ত ছাড়া এই গঙ্গাজল এদেশে সহজলভ্য ছিল না৷ দাক্ষিণাত্যে তো কোনোভাবেই নয়। কারণ গঙ্গার স্রোত তো আর গোটা ভারতজুড়ে বয়নি৷ অতএব চাহিদামত ভারতের যেখানে যেখানে গঙ্গা নেই সেখানে গঙ্গাজল পাঠাতে পারলে যে দুপয়সা ঝুলিতে আসতে পারে সেটা পাকা পাটোয়ারি বুদ্ধিতে অনুভব করেছিলেন বৈষ্ণবচরণ৷ তবে এটাও ঠিক যে তখন এমন ব্যবসা যে আর কেউ করত না, তা নয় ৷ তবু তিনি একটা ফাটকা খেলেছিলেন৷ বুঝেছিলেন, এক্ষেত্রে সফল হতে গেলে সুনাম অর্জন করতে হবে প্রথমে। আর তারপরই তাঁর জোগানো গঙ্গাজল সহজেই একটা ‘ব্র্যান্ড নেম’ হয়ে উঠবে। চিরকালই শুধু এদেশে নয়, সর্বত্রই চলেছে ধর্মের নামে লোক ঠকানোর কারবার৷
সেযুগে গঙ্গাজলের কারবারেও ছিল ভেজাল। ভাবা যায়! আর সেখানেই নাকি শেঠ বৈষ্ণবচরণ দেখিয়েছিলেন তাঁর কেরামতি ৷ তাঁর গঙ্গাজল যে একেবারে খাঁটি, ক্রেতাদের কাছে সেই আস্থা তিনি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর মুখবন্ধ হাঁড়িভর্তি গঙ্গাজল যেত গঙ্গাবর্জিত বিভিন্ন স্থানে৷ শুধু বাংলায় নয়, দেশের অন্য প্রান্তেও তাঁর গঙ্গাজলই ছিল ভরসা৷ সেই হাঁড়িগুলিতে থাকত 'শেঠ বৈষ্ণবচরণ' নামাঙ্কিত সিলমোহর, যা অন্যদের বেচা গঙ্গাজলের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে গণ্য হত ৷ দূর-দূরান্ত থেকে জমিদার, রাজারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে গঙ্গাজল নিয়ে যেতেন তাঁর কাছ থেকে।
শোনা যায়, সূদুর তেলেঙ্গানার রাজাও নাকি এই বৈষ্ণবচরণের গঙ্গাজলই ব্যবহার করতেন৷ প্রাচীনকাল থেকেই দাক্ষিণাত্যের রাজারাজড়াদের কাছে গঙ্গাজলের একটা আলাদা কদর ছিল৷ বিশেষ করে পুণ্যতোয়া জাহ্নবী তথা ভাগীরথীর জল ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷ কথিত আছে যে, রাষ্ট্রকূটরাজ যখন বঙ্গদেশ অধিকার করেছিলেন, তখন তিনি এখানকার নৃপতিদের মাথায় করে গঙ্গাজল বয়ে নিয়ে দাক্ষিণাত্যে পৌঁছে দিতে বাধ্য করেছিলেন৷
যাই হোক, গঙ্গাজলের এই ব্যবসায় বৈষ্ণবচরণের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল চণ্ডীপ্রসাদ নামে এক ব্যবসায়ী। তা একবার হয়েছিল কি চণ্ডীপ্রসাদের গঙ্গাজলের হাঁড়িতে ব্যাঙ পাওয়া গেল। ব্যাস! চণ্ডীপ্রসাদের গঙ্গাজল বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, লোকমুখে রটে গেল চণ্ডীপ্রসাদ কুয়োর জলকে গঙ্গার জল বলে বিক্রি করেন। চণ্ডীপ্রসাদের ব্যবসা বন্ধ হতেই বৈষ্ণবচরণ একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ পেয়ে গেলেন। রাতারাতি গঙ্গাজল বিক্রি করে একেবারে ফুলে-ফেঁপে উঠলেন। শোনা যায়, কামরুপের রাজা একবার দেড় লক্ষ গঙ্গাজলের পাত্র তাঁর কাছ থেকে ক্রয় করেছিলেন ।
দেখতে দেখতে বৈষ্ণবচরণের সহযোগিতায় চণ্ডীপ্রসাদের স্থান দখল করে নেন ঠাকুরবাড়ির আদিপুরুষ নীলমণি ঠাকুর। বৈষ্ণবচরণও তাঁকে প্রতিযোগী ভাবতেন না, সহযোগী ভাবতেন। বুদ্ধিমান নীলমণি মাটির হাঁড়ি ও কাপড়ের ঢাকনার পরিবর্তে টিনের পাত্র ও টিনের ঢাকনা ব্যবহার শুরু করেন, যাতে পাত্র হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ার কিম্বা জল কাপড় ভেদ করে গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। মানুষজন নীলমণি ঠাকুরের গঙ্গাজল হুড়োহুড়ি করে কিনতে লাগল। আর দেখতে দেখতে এই গঙ্গাজলের ব্যবসার মধ্য দিয়ে উত্থান হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এক আদি পুরুষের।
তথ্যসূত্র :
১| এক যে ছিল কলকাতা- পূর্ণেন্দু পত্রী
২| পুরনো কলকাতার কথা- জলধর মল্লিক
৩| কলিকাতার পুরাতন কাহিনি ও প্রথা- মহেন্দ্রনাথ দত্ত