সংক্ষিপ্ত
তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের পর মোদি সরকার কৃষিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন তার বিশ্লেষণ করলেন অনিরুদ্ধ সরকার।
২০২১ এর নভেম্বরে গুরুনানক জয়ন্তীতে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষকদের কোনও রকম দোষ না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "হয়তো আমাদের প্রচেষ্টাতেই কোনও খামতি রয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই আমরা কৃষকদের বোঝাতে পারিনি।
এবারের বাজেটে ৭টি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয় কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে। যার ফলে, কৃষি ক্ষেত্র আরও আধুনিক হয়ে উঠবে বলেই তাঁদের ধারণা।
প্রস্তাবগুলি হল-
- গঙ্গার উভয় তীরে ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে।
- কৃষকরা যাতে চাষাবাদ ও উদ্যান পালনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা পান, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
- বিদেশ থেকে পাম তেল আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে মিশন পাম তেল প্রকল্পের সূচনা হয়েছে।
- পিএম গতিশক্তি প্রকল্পের আওতায় কৃষি পণ্যের পরিবহণের জন্য নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
- কৃষি ক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও সংগঠিতভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বাড়বে।
- দেড় লক্ষেরও বেশি ডাকঘরে নিয়মিত ব্যাঙ্কিং পরিষেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর ফলে, কৃষকদের সমস্যা কমবে।
- দক্ষতা বিকাশের কথা বিবেচনা করে ও মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটানোর জন্য যুগের দাবি অনুযায়ী, কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণা ও শিক্ষা সংক্রান্ত পাঠক্রমে পরিবর্তন ঘটানো হবে।
গত আট বছরে কৃষি ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ অনেকটাই বেড়েছে৷ কৃষি বান্ধব বিভিন্ন নীতিও গ্রহণ করেছে মোদি সরকার৷ বর্তমান আর্থিক বছরে কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়ে ১.৩২ কোটি টাকা করা হয়েছে৷সরকার কৃষকদের সামাজিক উন্নয়নে কতটা উদ্যোগী,বাজেট বরাদ্দে এই বৃদ্ধিই তার প্রমাণ৷ ২০২১-২২ সালের আগাম হিসেব বলছে, এবার খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হতে চলেছে ৩১৫ মিলিয়ন টন৷ অন্যদিকে ফল ও সব্জি জাতীয় ফসলের উৎপাদন হতে পারে ৩৩৪ মিলিয়ন টন৷ যা সর্বকালীন রেকর্ড।করোনা অতিমারির মধ্যেও বিভিন্ন দেশকে খাদ্য শস্য সরবরাহ করেছে ভারত৷ এমন কি, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীনও বিভিন্ন দেশকে খাদ্যশস্য সরবরাহ করে সাহায্য করেছে ভারত৷ আর্থিক সমৃদ্ধির মুখ দেখছেন কৃষকরা। ২০১৩-১৪ সালে যেখানে প্রতি কুইন্টাল ধানের সহায়ক মূল্য ছিল ১৩১০ টাকা৷ তা বেড়ে এখন হয়েছে ১৯৪০ টাকা৷ অন্যদিকে ২০১৩-১৪ সালে গমের সহায়ক মূল্য ছিল কুইন্টাল প্রতি ১৪০০ টাকা, যা বেড়ে হয়েছে ২০১৫ টাকা৷ অতএব কৃষকদের দিন ফিরেছে।
মোদী এপ্রসঙ্গে জানান, কৃষি উৎপাদক সংস্থাগুলির মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকরা সম্মিলিত শক্তি অনুভব করছে। তিনি ছোট কৃষকদের জন্য কৃষি উৎপাদক সংস্থার ৫টি সুবিধার কথা তুলে ধরেন। এই সুবিধাগুলি হলো দর কষাকষির ক্ষমতা, দামের হার, উদ্ভাবন, ঝুঁকি মোকাবিলা এবং বাজারের অবস্থার সঙ্গে মানানসই ব্যবস্থাগ্রহণ। কৃষি উৎপাদক সংস্থাগুলির সুবিধার কথা মাথায় রেখে সরকার প্রতিটি স্তরে তাদের সাহায্য করছে। এই সংস্থাগুলি ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সাহায্য পাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, সারা দেশে কৃষি উৎপাদক সংস্থাগুলি জৈব চাষ, তৈল বীজ, মধু বাজারে নিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজ আমাদের কৃষকেরা ‘এক জেলা এক পণ্য’ এর মতো প্রকল্পগুলি থেকে উপকৃত হচ্ছেন এবং তাদের জন্য দেশ ও বিশ্বব্যাপী বাজার উন্মুক্ত হচ্ছে”। মোদি বলেন যে, ১১ হাজার কোটি টাকা বাজেটের জাতীয় ভোজ্য তেল মিশনের মতো প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ভোজ্য তেল আমদানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করা হচ্ছে।
আসুন এবার কৃষকস্বার্থের কথা মাথায় রেকে মোদি সরকারের পদক্ষেপগুলির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক-
প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি: ২০১৯ সালের অন্তর্বর্তী বাজেটে কৃষকদের আর্থিক সুবিধাদানের কথা ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি নামে এই কর্মসূচি ঘোষণার তিন সপ্তাহের মধ্যেই ২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ – এ চালু হয়। কর্মসূচি চালু হওয়ার পর থেকে নিয়মিতভাবে কৃষকদের কাছে কিস্তির টাকা পৌঁছে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর দ্বিতীয়বার কার্যকালের মেয়াদে প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রধানমন্ত্রী কিষাণ কর্মসূচির সুযোগ-সুবিধাগুলি সমস্ত কৃষকের কাছেই পৌঁছে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান যোজনায় ১১.৫০ কোটি কৃষক এখনও পর্যন্ত ১.৮২ লক্ষ কোটি টাকা পেয়েছেন।ফড়েদের বাদ দিয়ে কৃষকদের প্রতি সরকারের আনুগত্যেরও প্রমাণ এই প্রকল্প৷
কৃষক কল্যাণ কর্মসূচি: কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পের আওতায় থাকা যে সমস্ত কৃষকের ৫ একর পর্যন্ত জমি ছিল, তাঁদের জন্য এই কর্মসূচির সুবিধা সীমিত ছিল। সমস্ত কৃষকের কাছে এই সুবিধা সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে প্রতি বছর কৃষক কল্যাণে বছরে প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করবে কেন্দ্রীয় সরকার।ই-ন্যাম বা ই-জাতীয় কৃষি বাজার: কৃষিজ পণ্যকে আরও বেশি বাজারজাত করার লক্ষ্যে ই-ন্যাম বা ই-জাতীয় কৃষি বাজার মোদি সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
অর্গানিক ফার্মিং: জৈব পদ্ধতিতে কৃষিকাজের ওপর জোর দিয়েছে কেন্দ্র সরকার। রাসায়নিক মুক্ত কৃষকাজ করার কথা অনেক দিন ধরেই চলছিল। শেষ পর্যন্ত সেই বিষয়টির ওপর আরো একবার জোর দিয়েছে কেন্দ্র। এবারের বাজেটে এনিয়ে আলোচনাও হয়। গঙ্গার দু’পাশ ধরে প্রাথমিক পর্যায়ে এই রাসায়নিক বিহীন কৃষিকাজ শুরু কথাও বলা হয়েছে বাজেটে। পরে তা দেশের অন্যত্রও ছড়িয়ে দেওয়া হবে।সেই মর্মে কাজও চলছে। জৈব সারের প্রয়োগ: কেন্দ্র সরকার জৈব পদ্ধতিতে কৃষি কাজে উৎসাহ দেওয়ার ফলে আজ জৈব চাষে উৎপাদিত ফসলের বাজার ১১ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ছ’বছর আগে জৈব চাষে উৎপাদিত ফসল রপ্তানি করে ২ হাজার কোটি টাকা আয় হ’ত। বর্তমানে তার পরিমাণ ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি হয়েছে।
কৃষি সেচ: কেন্দ্র সরকার কৃষিকার্যের সুবিধার জন্য বিভিন্ন এলাকায় সেচ খাল ও ক্যানাল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র চাষীরা আরও ভালোভাবে উপকৃত হচ্ছেন। এইসব উদ্যোগের ফলে কৃষকরা এখন রেকর্ড পরিমাণে ফসল উৎপাদন করছেন।
কিষাণ ড্রোন সিস্টেম: কিসান ড্রোনের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এতে জমিতে সার দেওয়া, কীবটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। তাছাড়া জমির কোথায় ফসলের কেমন অবস্থা, তাও সহজে নজর রাখতে পারবেন কৃষকরা।
প্রধানমন্ত্রী কুসুম যোজনা:এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের পাশাপাশি সুরক্ষিত হবে পরিবেশও৷ কমবে দূষণ, কমবে বিদ্যুতের অপচয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকরা সোলার চালিত পাম্প বসানোর জন্য পাবেন ৬০ শতাংশ ভর্তুকি। ২০১৯ সালে এই প্রকল্পের সূচনা করেছিল ভারত সরকার৷ এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য জ্বালানি চালিত পাম্প কিনতে একদিকে যেমন কৃষকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, পাশাপাশি বিদ্যুৎ এর অপচয় ও হত। এই প্রকল্পের দ্বারা কৃষকরা সোলার পাম্প ব্যবহার করে বিনা জ্বালানির খরচনেই সেচ কাজ করতে পারবেন।
জল শক্তি মন্ত্রক: জলসম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের লক্ষ্যে ও সুদক্ষ ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী মোদী ২০১৯ সালের ৩০ মে নতুন দপ্তর হিসাবে জল শক্তি মন্ত্রকের সূচনা করেন।
সয়েল হেলথ কার্ড: এর মাধ্যমেও উপকৃত হচ্ছেন কৃষকরা।মাটির উর্বরতা বিচার করে সেই মর্মে সার প্রয়োগ করার এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিষয় নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে কেন্দ্র সরকার। আর সেকারণেই দেওয়া হচ্ছে এই কার্ড। প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত চাষি এবং কর্মী তৈরির এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ চলছে সয়েল হেলথ কার্ডের মাধ্যমে।
ন্যাচারাল ফার্মিং: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্দেশিকা মেনে ন্যাচারাল ফার্মিং-এর উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি দফতর৷ উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পাড়ে পাঁচ কিলোমিটার করে এলাকায় এই ন্যাচারাল ফার্মিং শুরু হবে৷
প্রধানমন্ত্রী কিষাণ যোজনা: এর মাধ্যমে সরকার সোলার পাম্প বা নলকূপ স্থাপনের জন্য কৃষকদের ৬০% পর্যন্ত ভর্তুকি এবং ৩০% পর্যন্ত ঋণ দেবে। সৌর পাম্প বিতরণ, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, নলকূপ নির্মাণ এবং বিদ্যমান পাম্পকে সোলার পাম্পে পরিণত করাও এই প্রকল্পের আওতায় পড়ে। কুসুম যোজনার মূলত দু’টি সুবিধে রয়েছে৷ প্রথমে কৃষকদের সৌরশক্তি চালিত পাম্প দেওয়া হবে। তাই তাঁদের ডিজেল বা পেট্রোল পাম্প লাগবে। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের এই পাম্প সেটের সাহায্যে এনার্জি পাওয়ার গ্রিড দেওয়া হয়েছে এবং কৃষকদের কাছে যা কিছু উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জমা হবে, তারা তা সরাসরি সরকারের কাছে পাঠাবে। ফলে এর মাধ্যমেও কৃষকদের আয়ও বাড়বে। এক্ষেত্রে কৃষকদের মোট খরচের মাত্র ১০% ব্যয় করতে হবে। যারা বৈদ্যুতিন পাম্প ব্যবহার করছেন তারা এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন না।
কিষাণ ক্রেডিট কার্ড: কোভিড মহামারীর কঠিন সময়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে ৩ কোটি কৃষককে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে। পশু পালন ও মৎস্য চাষের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরও এই কার্ডের আওতায় আনা হয়েছে।
আরও পড়ুন - রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর মারাত্মক হামলা, গাড়ির কাছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ
পাঞ্জাবের কৃষক উৎপাদক সংস্থাগুলির সঙ্গে বার্তালাপের সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের উৎপাদিত ফসলের অবশিষ্টাংশ আগুনে না পুড়িয়ে ভিন্ন উপায় সম্পর্কে অবহিত করেন। সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে উন্নতমানের বীজ এবং সরকারী সংস্থার সাহায্যের কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের ‘পারালি’ পদ্ধতিতে চাষের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা সর্বত্র ভাগ করে নেওয়ার আহ্বান জানান। রাজস্থানের কৃষক উৎপাদক সংস্থাগুলির সঙ্গে মধু তৈরির বিষয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। গুজরাটের কৃষক উৎপাদক সংস্থাগুলি প্রাকৃতিক চাষ এবং কীভাবে গরু-ভিত্তিক কৃষিকাজ মাটির ওপর চাপ ও খরচ কমাতে পারে সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন।২০২৩ সালটিকে আন্তর্জাতিক বাজরার বছর বা ‘International Year of Millet’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন - প্রকৌশল শিক্ষাকে আরও উন্নত করার প্রতিশ্রুতি, ইঞ্জিনিয়ারিং দিবসে মোদীর নতুন দিশার ঘোষণা