সংক্ষিপ্ত
বাংলার লোকক্রীড়াকে স্থল, জল ও অন্তরীক্ষ— এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ভূমির ওপর খেলা হল স্থলের খেলা, সাঁতার কাটা, নৌকা-বাইচ ইত্যাদি জলের খেলা, আর ঘুড়ি ওড়ানো অন্তরীক্ষের খেলা। শরীরচর্চা, চিত্ত বিনোদন, ধর্মীয় সংস্কার ইত্যাদি কারণে লোকক্রীড়ার চর্চা প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে।
মননশীল প্রবন্ধ, বাংলার রায়বেঁশে- পৌলোমী মুখোপাধ্যায়--- বুমবুম বড্ড জেদী, একগুঁয়ে হয়ে উঠেছে। কথাও কম বলে। ঘাড় গুঁজে কম্পিউটারে নয় ঠাম্মার মোবাইলে গেম খেলে চলেছে রাত্রিদিন। কোনোমতে পড়া করে নিয়েই পাবজি, টেম্পল রান, শ্যাডো ফাইটের মায়া দুনিয়া। খাওয়াদাওয়াও কমে গেছে। শারীরিকভাবে একটু দুর্বলও। করোনার দাপটে স্কুল যাওয়া বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। বিকেলে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলাও বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। কি করে যে তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়? সেদিন বাবাই ছাদে উঠে তাকে ঘুড়ি ওড়ানো দেখাল। মাম্মামও এক্কাদোক্কা আর কাবাডি খেলার কথা বলছিল। ঠাম্মা বলছিল পুতুলের বিয়ে দেবার গল্প। এগুলো সব আগেকার গ্রামবাংলার খেলা। এগুলোকে বলে লোকক্রীড়া।
বুমবুমের মতো আমরা বড়োরাও ভার্চুয়াল জগৎ নিয়ে মেতে আছি খুব। অথচ মাত্র এক প্রজন্ম আগে এই আমাদের ছোটোবেলার অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল কুমিরডাঙা, এক্কাদোক্কা, দাঁড়িয়াবান্ধা, কাবাডি ইত্যাদি খেলা।
বাংলার লোকক্রীড়াকে স্থল, জল ও অন্তরীক্ষ— এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ভূমির ওপর খেলা হল স্থলের খেলা, সাঁতার কাটা, নৌকা-বাইচ ইত্যাদি জলের খেলা, আর ঘুড়ি ওড়ানো অন্তরীক্ষের খেলা। শরীরচর্চা, চিত্ত বিনোদন, ধর্মীয় সংস্কার ইত্যাদি কারণে লোকক্রীড়ার চর্চা প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে।
বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রতচারী চর্চা, কুস্তি, নৌকা-বাইচ, লাঠিখেলা, রায়বেঁশে প্রভৃতি খেলার চর্চা আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। শারীরিক, চারিত্রিক ও সামাজিক গঠনে এই খেলাগুলির অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে রায়বেঁশের মধ্য দিয়ে ধনুক, বর্শা ও তলোয়ার চালানোর কৌশল রপ্ত করা হয়। আমরা আজ রায়বেঁশে নিয়ে আলোচনা করব।
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আকবর বাদশাহ সেনাপতি মান সিংহকে মুর্শিদাবাদের সামন্ত রাজত্বে পাঠান বিপ্লবী সামন্তকে শায়েস্তা করতে। সহকারী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন সবিতা রায় দীক্ষিত। সঙ্গে ছিল দুর্ধর্ষ ভিল যোদ্ধারা। তারা সামন্ত রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করেন। পুরস্কারস্বরূপ সবিতা রায়কে ফতে সিং পরগনার শাসক নিযুক্ত করা হয়। এই ভিল গোষ্ঠীই জমিদারদের লেঠেল হিসেবে তলোয়ার, বল্লম ও লাঠিখেলার চর্চা বাংলার বুকে অব্যাহত রাখে। ঘাঘরা পরে নৃত্যছন্দে বাদ্যভাণ্ডের তালে তালে দস্যু দমনে যেত এই রায়বেঁশে দল।
রায়বাঁশ থেকে রায়বেঁশে নামের উদ্ভব বলে অনেকে মনে করেন। আবার রাই বেশ (নারীর বেশ) থেকেও কথাটির উদ্ভব বলা যেতে পারে। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান-ই রায়বেঁশের বিকাশ কেন্দ্র। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে গুরুসদয় দত্ত মহাশয় বীরভূমে জেলাশাসক থাকাকালীন এর সাথে পরিচিত হন এবং ব্রতচারীর মধ্য দিয়ে এই লুপ্তপ্রায় নৃত্যক্রীড়াকে পুনরুজ্জীবিত করেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও রায়বেঁশের প্রতি দুর্বল ছিলেন।
রায়বেঁশের জন্য নামডাক আছে কাটোয়ার কোশিগ্রামের শিল্পীদের৷ সাধারণত জনা ১৫ সদস্য নিয়ে একটি রায়বেঁশে নৃত্যের দল তৈরি হয়৷ কোশিগ্রামের এমনই এক দলের দলপতি দুখোহরণ পণ্ডিত শোনালেন রায়বেঁশের গল্প৷ তিনি বলেন, “আমার পরিবার ৬-৭ পুরুষ ধরে রায়বেঁশে নাচের সঙ্গে যুক্ত৷ আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন রাজা-জমিদারদের লাঠিয়াল৷ দেহরক্ষীর কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে রাজারানির মনোরঞ্জনও করতে হত৷ এক দিকে যেমন শত্রুর সঙ্গে লড়তে হতো, অন্য দিকে, তেমন নাচের মধ্যে দিয়ে আনন্দ দিতে হতো প্রভুদের৷ সেই লাঠিখেলার কসরতই এখন রায়বেঁশে নৃত্য হয়ে রয়ে গিয়েছে৷ আমরা বাজনার তালে তালে যুদ্ধের মহরা দিই৷ আগেকার দিনে লাঠি যুদ্ধ কেমন হতো, তাই দেখানো হয় রায়বেঁশেতে৷ তবে শুধু যে লাঠি খেলাই দেখানো হয়, তা নয়৷ বাজনার তালে আরও নানা শারীরিক কসরত দেখাই আমরা৷ দলে কয়েক জন থাকেন যাঁরা ঢোল আর কাঁসর বাজান; আর বাকিরা নৃত্য প্রদর্শন করেন৷ সাজটা এখানে খুব জরুরি৷ নাচের সময় আমাদের লাঠিয়াল বেশের সাজ অনুষ্ঠানকে আরও সুন্দর করে তোলে৷ মুখ থেকে নানারকম আওয়াজ করতে হয় নাচের সময়৷ আগেকার দিনের লাঠিয়ালরা এই ধরনের আওয়াজ করে সাবধান করত শত্রুপক্ষকে৷ এখন তো সরকারি উদ্যোগের ফলে আমাদের আয়ও বেড়েছে এই পেশায়৷ বেড়েছে পরিচিতিও৷ তবে আমাদের দুশ্চিন্তার মূল কারণ হল, নতুন প্রজন্মের কেউ আর তেমনভাবে এই পেশায় আসছে না৷ তাই এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা চিন্তা থেকেই যাচ্ছে৷” রায়বেঁশে শিল্পীরা জানচ্ছেন, বর্তমানে নানা সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁদের ডাক আসছে৷ সাধারণ মানুষও ডাকছে অনুষ্ঠান করার জন্য৷ মাসে এক একজন শিল্পী হাজার দশেক টাকা উপার্জন করতে পারছেন রায়বেঁশে থেকে৷ বাকি সময় চাষবাস তো আছেই।
বর্তমানে শান্তিনিকেতনে ব্রতচারীর মধ্য দিয়ে রায়বেঁশেকে জনসমক্ষে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চলছে। গুরুপরম্পরা প্রাপ্ত ব্রতচারী শ্রী নরেশ বন্দোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করতেই হয়। ব্রতচারীর মূলধারা বজায় রেখে সমগ্র জীবন ব্রতচারী প্রসার ও প্রচারে নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন নরেশজি। ব্রতচারী গ্রাম (মিউজিয়াম) থেকে অবসরপ্রাপ্ত হয়ে শান্তিনিকেতনে ব্রতচারীর শিক্ষকতা করেছেন। দেশে ও বিদেশে রায়বেঁশেকে জনপ্রিয় করায় তাঁর অবদানও কম নয়।
বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে বিশেষ করে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের মতো জঘন্য পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তি পেতে এবং মানসিক বলিষ্ঠতা বজায় রাখতে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে রায়বেঁশেকে জনপ্রিয় করতে হবে। আমাদের সরকারও এ-বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। ক্যারাটে, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনের পাশাপাশি রায়বেঁশেকেও সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।
কুস্তি, তলোয়ার, লাঠি খেলা, আগুনখেলার সমন্বয়ে সৃষ্ট এই রায়বেঁশে দল পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠুক নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। প্রতিরোধ হোক জোরদার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এইসব ঐতিহ্যাশালী পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় নিতে হবে আমাদের নিজেদেরই। তাহলেই বুমবুমরা আর প্রাণহীন ডিজিটাল গেমসের মাধ্যমে প্রাণ খুঁজে নিতে যাবে না। শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে আগামী প্রজন্মকে একটি সুস্থ-সচেতন সমাজ উপহার দিতে পারব আমরা।
লেখক পরিচিতি- পৌলোমী মুখোপাধ্যায় পেশায় জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার। পশ্চিমবঙ্গ সেচ ও জলসম্পদ দপ্তরে কর্মরত। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘ, বৃষ্টি, রোদ্দুর’ এবং গল্প সংকলন ‘জার্নি’। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমে লেখালেখির কাজের সঙ্গে যুক্ত।
সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময় মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।