সংক্ষিপ্ত
১০ বছর পরও অটুট মমতা-ম্যাজিক
কার্যত একাই ঠেকালেন বিজেপির ভোট মেশিনারিকে
থমকে গেল মোদী-শাহ'র রথ
মোদী বিরোধী জোটের প্রধান মুখ হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়
এইবারের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের একেবারে শুরু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় যে রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করেছিলেন, তা হল বিজেপির সব কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে একাই লড়ছেন তিনি। পরে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনও। আর এই 'অসম লড়াই'এ তিনি পাশে পেয়েছিলেন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের আরও বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দলের সমর্থনও। এদিনের জয়ের পর সারা ভারত থেকেই তাই বইছে অভিনন্দনের বন্যা। যা দেখে রাজনৈতিক মহল মনে করছে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদী বিরোধী জোটের মুখ হতে চলেছেন তিনি।
বিধানসভা নির্বাচনের আগেই খোলাখুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় তথা তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন জানিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব, মহারাষ্ট্রের মহা আগাড়ি সরকারের দুই জোট সঙ্গী শিবসেনা ও এনসিপি, বিহারের মহাজোটের দুই শরিক আরজেটি এবং সিপিআই (এমএল)। এর মধ্যে মহারাষ্ট্র সরকারের জোট শরিক কংগ্রেস এবং বিহারের মহাজোটের শরিক কংগ্রেস ও বাম দল কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের মধ্য়ে জোট গড়ে লড়েছিল। তারপরও, আঞ্চলিক দলগুলি বিজেপির বিরুদ্ধে মমতাকেই সমর্থন করেছিল। অখিলেশ যাদব রাজ্যে তৃণমূলের হয়ে প্রচারে পাঠিয়েছিলেন জয়া বচ্চনকে, আর আরজেডির তেজস্বী যাদব তো নিজেই এসেছিলেন মমতার কাছে।
বাংলার মমতার দারুণ জয়ের পর এঁদের সকলেই অভিনন্দন জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রীকে। এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার টুইট করে বলেছেন, 'দারুণ জয়ের জন্য মমতাকে অভিনন্দন! আসুন আমরা জনকল্যাণে এবং সম্মিলিতভাবে মহামারী মোকাবিলার উদ্দেশ্যে আমাদের কাজ চালিয়ে যাই।'
অখিলেশ যাদব টুইট করে বলেছেন, 'পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ঘৃণার রাজনীতিকে পরাজিত করার জন্য সেখানকার জনগণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃমমূল কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের আন্তরিক অভিনন্দন! এটা বিজেপি যে এক মহিলাকে 'দিদি ও দিদি' বলে আপত্তিজনক কটাক্ষ করেছিল, তারই জনসাধারণের দেওয়া উপযুক্ত উত্তর। দিদি, জিও দিদি।' লালুপ্রসাদ যাদব বলেছেন, 'সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এই ঐতিহাসিক জয়ের জন্য মমতাজিকে আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন
। আমি আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। যারা দিদির পক্ষে আন্তরিকভাবে ভোট দিয়েছেন এবং বিজেপির বিতর্কিত ও বিভাজনমূলক প্রচারের ফাঁদে পড়েননি, বাংলার সেইসবব মানুষদেরও ধন্যবাদ জানাতে ও অভিনন্দন জানাই।'
জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্য়মন্ত্রী মেহবুবা মুফতি বলেছেন, 'দুর্দান্ত জয়ের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়, তৃণমূল কংগ্রেস এবং ডেরেক ও'ব্রায়ানকে অভিনন্দন
। বিদ্রোহী ও বিভাজনবাদী শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে কুর্ণিশ। আরেক প্রাক্তন মুখ্য়মন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বলেছেন, 'পশ্চিমবঙ্গে অসাধারণ বিজয়ের জন্য মমতাদিদি এবং রাজ্যের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন
। বিজেপি এবং সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনের সব বাধা পিছনে ফেলে আপনি জয়ী হয়েছেন। আগামী ৫ বছরের জন্য শুভেচ্ছা রইল।'
দিন কয়েক আগেই রাজ্যে প্রচারে এসে মমতাকে পিসি বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এদিন কিন্তু, জয়ের পর মমতাকে তাঁরাও অভিনন্দন জানাতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং টুইট করে বলেছেন, 'পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দলের জয়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা দিদিকে অভিনন্দন। তাঁর পরবর্তী মেয়াদের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল।' আর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টুইট করে বলেছেন, 'বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ফের নির্বাচিত হওয়ায় মমতা দিদিকে অভিনন্দন
। আপনার পরবর্তী মেয়াদের জন্য শুভকামনা রইল।'
তবে আসল কথাটা বলেছেন শিবসেনা সাংসদ সঞ্জয় রাউত। বাংলার ভোটে শিবসেনা মমতাকে সমর্থন করায়, ২ মে ফলপ্রকাশের পর মহারাষ্ট্রেও সরকারের পতন হতে পারে বলে হাওয়া উঠেছিল। এদিনের ফল প্রকাশের আগেই তিনি তাঁর দলের মুখপত্র সামানা-র সাপ্তাহিক কলামে লিখেছেন, '২ মে ফলের পর দিল্লিতেও কিন্তু কম্পন অনুভূত হবে'।
বস্তুত যেভাবে প্রায় প্রতিদিন বাংলায় প্রচার করতে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে বিজেপির জাতীয় সবাপতিরা, তাতে বঙ্গে এই হার বিজেপির জাতীয় স্তরের নেতাদেরই হার। আর এই কারণেই ৫ রাজ্যের নির্বাচন হলেও, গোটা দেশের চোখ ছিল বাংলার নির্বাচনের দিকেই। বিজেপির বিরুদ্ধে একা লড়ে এই ব্যাপক জয় তুলে আনায় কিন্তু, জাতীয় রাজনীতিতে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে নির্বাচন তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে সাপলুডোর সাপের মুখ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সেই নির্বাচনই কিন্তু, তাঁর পায়ের নিচে একটি লম্বা মই এনে দিল।
তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু, আগেই বলে রেখেছে, নন্দীগ্রাম ছাড়া আর কোনও কেন্দ্র থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় যদি লড়েন, তা হবে বারানসী কেন্দ্র। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের সংসদীয় কেন্দ্র। মমতা স্বয়ং বলেছেন, এক পায়ে বাংলা জয় করবেন, দুই পায়ে দিল্লি। ২০২৪ সাল আসতে আর মাত্র ৩ বছরের অপেক্ষা। এর আগে পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি নিজেদের নির্বাচনী ময়দানে প্রায়য় অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসাবে প্রমাণ করেছিলেন। তাদের সেই অশ্বমেধের ঘোড়া কার্যত একাই থামালেন তৃণমূল নেত্রী। আর সেটাই প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে মমতাকে অনেকটা এগিয়ে দিল।