রবীন্দ্র গানেই মান্নার প্রেম, প্রাপ্তি জীবনসঙ্গীও

  • মান্না দে মানেই বাংলা আধুনিক গান, রাগপ্রধান, গজল, ঠু্ংরি, ভজন।
  • তিনিও মাতোয়ারা হয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে।
  • রবীন্দ্রসঙ্গীতের সব নোটেশন মান্না দে'র কন্ঠস্থ ছিল। 
  • রবীন্দ্র সঙ্গীতের নিয়মিত রেয়াজ চলত তাঁর বাড়িতে। 

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

কেন আমায় পাগল করে যাস..
ওরে চলে যাবার দল...
রবি ঠাকুরের এই গানটি কালজয়ী হয়ে গিয়েছিল মান্না দে-র কন্ঠে। অনেকেই চমকে যাবেন, ভাবতে থাকবেন মান্না দে ও রবীন্দ্র সঙ্গীত, কিভাবে সম্ভব?

Latest Videos

যে মানুষটি মানেই বাংলা আধুনিক গান, রাগপ্রধান, গজল, ঠু্ংরি, ভজন, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতেও মাতোয়ারা করে দিয়েছিলেন?
ইমরান খানের একটি সাক্ষাৎকারের কথা এ প্রসঙ্গে মনে চলে আসছে। একবার কিং খানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কে আসল ক্যাপ্টেন? ইমরান জানিয়েছিলেন, সেই ক্যাপ্টেন ভাল যিনি পছন্দসই দল না পেলেও ঘ্যানঘ্যান করবেন না। আর যে কোনও সাধারণ দলকে তিনি বিশ্বসেরা করার স্বপ্ন দেখাবেন। 

আরো পড়ুনঃরবীন্দ্র জয়ন্তীতে রাজচন্দ্র-রাসমণীর বিশেষ উদ্যোগে, লকডাউনে ভিন্ন ধারায় মন ভরল রবিপ্রেমীদের

প্রয়াত মান্না দে সঙ্গীতের সেই ‘বিরল ক্যাপ্টেন’। যিনি যে গানই গেয়েছেন, সেটি এমন দরদ দিয়ে পেশ করেছেন, যা জনমানসে অমর হয়ে গিয়েছে। গানের বিষয়ে তাঁর কোনও ছুঁতমার্গ ছিল না। মোট ১৩টি ভাষায় মোট পাঁচ হাজার গান গেয়েছেন বেসরকারী হিসেবে। 
যা বলছিলাম, যে গানের স্তবক দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছে, সেই গানের রেকর্ডিং ছিল ১৯৮৬ সালে এইচএমভি কোম্পানিতে। সেবার ছিল রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। কলকাতা অফিসে মান্না দে গানটি গাইছেন, শুরু করেছেন তাঁর নিজস্ব মেজাজি ভঙ্গিতে, ‘‘কেন আমায় পাগল করে যাস...’’ গানটি শোনার পরে স্টুডিওর সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। সবাই চেয়ে ছিলেন কিংবদন্তি গায়কের দিকে। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ শিল্পী সুচিত্রা মিত্র। তিনি এগিয়ে এসে মান্না দে-কে বলেছিলেন, ‘‘আপনি কেন মান্না দে আজ আরও একবার বুঝলাম। উফ! কী অনুভূতি নিয়ে গাইলেন আপনি। অনেক রবীন্দ্র শিল্পীও বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে আপনার গান শুনে।’’  

আরও পড়ুনঃনিজের কবিতায় নিজেকে শুভেচ্ছা, কীভাবে জন্মদিন পালন করতেন কবিগুরু

এই ঘটনার কথা জানিয়ে কিঞ্চিৎ আবেগবিহ্বল তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ভাইপো সুদেব দে। যাঁকে তিনি নিজের মনের মতো করে তৈরি করেছেন। সুদেবই জানালেন, ‘‘সেইসময় কাকা ৯ মদনমোহন ঘোষ লেনে ছিলেন। আমাকে সকালে উঠেই বললেন, সুদেব চলো আজ তোমাকে স্টুডিওতে নিয়ে যাব, রেডি হয়ে নাও, আমার গানের রেকর্ডিং রয়েছে। চলো কিছু শিখবে। সেদিন সত্যিই আমি অনেককিছু শিখেছিলাম।’’ সুদেব দমদম নাগেরবাজারের বাড়ি থেকে আরও জানালেন, ‘‘আমার কাকা হলেন সাধক মানুষ। সঙ্গীতের পূজারী ছিলেন, তিনি এতটাই পারফেক্টশনিস্ট ছিলেন যে গানের ক্ষেত্রে তিনি কোনও ধরনের ভুল কিংবা গাফিলতি মানতে পারতেন না।’’ সুদেবই বলছিলেন, ‘‘অনেকেই হয়তো জানেন না কাকার গাওয়া বহু রবীন্দ্রসঙ্গীত রয়েছে, যা শুনলে এখনও আমার চোখ ভিজে যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সব নোটেশন কাকার কন্ঠস্থ ছিল। তিনি রীতিমতো বাড়িতে রেওয়াজ করতেন রবীন্দ্র সঙ্গীত।’’

মান্না দে-র জীবনে রবীন্দ্রনাথ আরও এক অন্যরকমভাবে এসেছিলেন। রবীন্দ্র গান তাঁর জীবনে এনেছিল প্রেম, ভালবাসা, জীবনসঙ্গীও। মান্নার যিনি স্ত্রী ছিলেন তিনি ছিলেন কেরলিয়ান, নাম সুলোচনা কুমারন। তিনি ছিলেন মুম্বাই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপিকা। তাঁর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে দারুণ বুৎপত্তি ছিল। ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেও পারতেন। সুলোচনা দেবীদের মুম্বাইতে (তখন অবশ্য বোম্বাই) একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গ্রুপ ছিল। তিনি ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সেই গ্রুপে অতিথি শিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রিত হন মান্না দে। তিনিও সেইসময় মুম্বাইতে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন। তবুও বেশ কয়েকটি গান গেয়ে নামডাকও করেছিলেন। সেই পরিচিতি থেকে বিশেষ করে বাঙালি বলে সেই গ্রুপের শিক্ষক হয়েছিলেন। আর ওই গ্রুপের গায়িকা হিসেবে পরিচিতি ছিল সুলোচনার। 

আরও পড়ুনঃরসনা তৃপ্তিতেও অভিনবত্বের ছোঁয়া, জানুন খাদ্যরসিক রবীন্দ্রনাথের বিশেষ গুণের কথা

সেই থেকেই মান্নার সঙ্গে সুলোচনার প্রেম, পরে বিবাহ। পরে একবার এক সাক্ষাৎকারে মান্না পত্নী বলেছিলেন, আমি ভাগ্যবান যে মান্না দে-কে স্বামী হিসেবে পেয়েছি। ওঁদের এই সম্পর্কের পরোক্ষ মাধ্যমও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আরও ভাল করে বললে তাঁর গান। সুদেবই স্মৃতির সরণী বেয়ে জানালেন, ‘‘মুম্বাইতে কাকা ও কাকিমার ডুয়েট গান বহুবার শুনেছি। কাকিমার রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি নিবিড় প্রেম ছিল। তাঁর পান্ডিত্য ছিল রবীন্দ্রনাথ নিয়ে, অথচ তিনি ছিলেন কেরালার মেয়ে।’’ 
যদি তারে নাই চিনি গো সেকি
সেকি আমায় নেবে চিনে 
এই নব ফাগুনের দিনে, জানি নে... 
মান্নার কন্ঠে জনপ্রিয় হওয়া এই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ডাক আসে ভাইপো সুদেবের কাছেও। তিনি বলছিলেন, বহু ফাংশনে কাকার গাওয়া এই রবীন্দ্র গান গাওয়ার কথা বলেন মানুষ। অনেকেই আমার মধ্যে কাকাকে খুঁজতে চান, এটা আমার কাছে আশীর্বাদ। এই গান শুনে অনেকেই আবেগে ভাসতে থাকেন, তাঁদের চোখে জল দেখি। এই গানেরই হিন্দী গান, ‘‘তেরে মেরে মিলন কী হ্যায় র্যা য় না...।’’ 
মান্না দে-র কন্ঠে নয় নয় করে মোট ৫০টি রবীন্দ্রসঙ্গীত রয়েছে। হিন্দীতেও রবীন্দ্র গান গেয়ে সুর মুর্ছনায় ভাসিয়ে দিয়েছেন মানুষকে। তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ, ‘‘অনেক কথা যাও যে বলি/কোনও কথা না বলি/ তোমার ভাষা, বোঝার আশা/ দিয়েছে জলাঞ্জলী...।’’ আবার এও গেয়েছেন, ‘‘না চাইলে যারা পাওয়া যায়...।’’ কখনও শোনা গিয়েছে, ‘‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে...।’’ এই গানগুলি মান্নার কন্ঠে বাঙালি ধমনীতে তুফান তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

সুদেবই কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘‘আমাকে একবার এক টিভি অনুষ্ঠানে সঞ্চালক প্রশ্ন করেছিলেন, আমার রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুই সেরা শিল্পী কে? অবশ্যই কাকা ছাড়া। আমি নাম করেছিলাম কিশোর কুমার ও আশা ভোঁসলের। তিনি আমাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন এ আবার কী বলছেন? আমি পালটা তাঁকে জানিয়েছিলাম, আমার বিচারবুদ্ধি তো তোমার মতামত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। আশার যেমন ওই গান, ‘‘সহে না যাত না...।’’  আহা! কী সব নোট লাগিয়েছেন। কিংবা কিশোর কুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘‘সগ না গহন না রাত্রী ভরিছে শ্রাবণ ধারা...।’’

জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রন
ধন্য হলো, ধন্য হলো...
সুবিনয় রায়ের কন্ঠে এই গানও জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল। সুদেব দে-র কথায়, সুবিনয় রায়ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম সেরা শিক্ষক। তবে আমার কাকা সবসময় বলতেন পঙ্কজ মল্লিকের গান শুনতে। কাকা আমাকে রেকর্ড প্লেয়ার জোগাড় করে ওনার গান শোনাতেন। রবীন্দ্র গানকে স্মরণীয় করেছিলেন মল্লিক বাবু। সেইসময় সাউন্ড সিস্টেম এত ভাল ছিল না, তাও যে গান তিনি গেয়েছিলেন, তা মনকে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে।

আরও পড়ুনঃমহামারীতে মৃত্যু দেখেছিল ঠাকুর পরিবারও, জানুন সেই মৃত্যযন্ত্রণার কাহিনি

 

Share this article
click me!

Latest Videos

জাল পাসপোর্ট মামলায় Mamata Banerjee-কে ধুয়ে দিলেন Sukanta Majumdar, দেখুন কী বলছেন তিনি
Bangla News Live : মোদীকে চরম হুঁশিয়ারি দিলেন সারজিস আলম | PM Modi | Sarjis Alam
সনাতন শ্রী গীতা গুরুকুলের মিছিলে Bangladesh-এ শান্তি ফেরানোর আহ্বান! Phulia-র রাস্তায় মহামিছিল
কি স্পর্ধা! সরাসরি মোদীকে হুমকি! Sarjis Alam on PM Modi #shorts #shortsvideo #shortsviral
'বাজপেয়ীজি না থাকলে তৃণমূলের জন্মই হত না' লোকসভায় বিস্ফোরক মন্তব্য Samik Bhattacharya-র