'বাঙালিই তো আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে', কিংবদন্তি দিলীপ কুমারের স্মৃতিচারণায় তপন বক্সী

  • প্রয়াত হলেন বলিউডের ট্র্যাজেডি কিং দিলীপ কুমার।
  • টাইম মেশিন এর হাত ধরে ফিরে যেতে হচ্ছে ২৭ বছর পিছনে
  • দিলীপ সাদা রঙের পোশাকই পছন্দ করতেন বেশি
  • বাঙালিই তো আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে

তপন বক্সী: টাইম মেশিন এর হাত ধরে ফিরে যেতে হচ্ছে ২৭ বছর পিছনে। ১৯৯৪-এর আগস্ট মাস। কলকাতার প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্র গোষ্ঠীর ম্যাগাজিনের মুম্বই প্রতিনিধি এই প্রতিবেদক।ওই সংবাদপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে তখন চুক্তিবদ্ধ ছিলেন মুম্বইয়ের জে.জে. স্কুল অব আর্টস থেকে স্নাতক হওয়া বিখ্যাত ফ্যাশন ফোটোগ্রাফার তৈয়ব বাদশা। তৈয়ব সাত এবং আটের দশকে বহুল প্রচারিত এবং তুমুল জনপ্রিয় সিনেমা মাসিক 'স্টারডাস্ট'-এর চিফ ফোটোগ্রাফার ছিলেন। তৈয়ব বাদশার সঙ্গে বলিউডের তাবড় সেলিব্রিটিদের রাতদিন ওঠা-বসা তখন। তাঁরা তৈয়বের বাড়িতেও আসেন।  

 

Latest Videos

 

পেশাদার ফোটোগ্রাফির জন্য এবং তার বাইরে ব্যক্তিগতভাবে দিলীপ কুমারের গুণমুগ্ধ ভক্ত হওয়ার জন্য দিলীপের সঙ্গে বেশ গভীর সম্পর্ক ছিল তৈয়বের। সাত এমনকি আট কিম্বা নয়ের দশকেও নিজের ছবির আউটডোরে দিলীপ কুমার সঙ্গে নিতেন তৈয়বকে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। '৯৪- এর মুম্বইয়ে তৈয়ব আমার অগ্রজ সহকর্মী আর আমি তৈয়বের ছায়াসঙ্গী। সেই তৈয়বই একদিন হঠাৎ বললেন, 'কাল দিলীপ সাব কা বাংলো মেঁ শুট হ্যায়। আ রহা হ্যায় ক্যায়া মেরে সাথ?' কে আর 'না' বলে? পরদিন দুপুরের একটু আগেই আমরা  পৌঁছে গেলাম ৩৪-বি, পালি হিল। সায়রা বানুর বাংলোয়। এই বাড়িতেই আজীবন কাটালেন দিলীপ কুমার। ৪৮, পালি হিল দিলীপের নিজের বাংলো। কিন্তু ভাইদের সেখানে থাকতে দিয়ে দিলীপ থাকতেন সায়রার বাংলোতে। 

 

 

সেদিন সায়রার বাংলোর লবিতে আমাদের আড়াই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দিলীপ কুমারের জন্য। ছবি তোলার আগে তিনি রেডি হয়ে নিচে নেমে আসবেন। তখনই তিনি খুব কম লোকের ফোন ধরেন। দেখা করা তো আরও কম। হঠাৎ চোখে পড়ল লবির মূল এন্ট্রান্সের গায়ে দরজার পাশের বসার জায়গায় অপেক্ষা করছেন একজন। কাছে গিয়ে দেখলাম, তিনি কলকাতার পরিচালক রাজা সেন। রাজার হাতে তপন সিংহর লেটারহেডে তপনবাবুর লেখা চিঠি। দেখলাম তপনবাবু নীল কালিতে দিলীপ কুমারকে 'ডিয়ার ইউসুফ' বলে সম্বোধন করেছেন। তপনবাবুর ওপর একটি তথ্যচিত্রে দিলীপ কুমারের বক্তব্য রেকর্ড বা শুট করার জন্য রাজা এসেছেন। দিলীপ যে সিঁড়ি বা লিফট দিয়ে নিচে নেমে আসবেন, লবিতে তার ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে তৈয়বেরই তোলা দিলীপ-সায়রার এক বিশাল রঙিন পোর্ট্রেট ফ্রেমের ভেতর জ্বলজ্বল করছে। 

 

 

দিলীপ সাদা রঙের পোশাকই পছন্দ করেন বেশি। সেদিনও দেখলাম  দুধসাদা গলাবন্ধ ফুল স্লিভ শার্ট। সাদা ট্রাউজার্স। পরিচারকেরা এক এক করে স্যুট, টাই অন্য রঙের ট্রাউজার্স নিয়ে আসছেন। তার আগে ফাঁকা সময়কে কাজে লাগিয়ে তৈয়ব লাইটিংয়ের কাজ সেরে রেখেছেন। দিলীপ এসে বসলেন একটা সোফায়। তৈয়ব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন তিনি ৭১। চেহারায় যে দীপ্তি, যে বনেদিয়ানা দেখলাম, বয়স তাতে বেশ পিছিয়ে যাচ্ছে হার মেনে। কথা বলেন কম। শোনেন বেশি। আর বুঝলাম অবজার্ভ করেন সামনের মানুষ আর পরিবেশকে খুব শান্তভঙ্গিতে। বিশ্লেষকের চোখে। আমি যে মূলত কলকাতার এবং বাঙালি, সেটা শুনে বেশ আনন্দ পেলেন মনে হল। 

 

 

ধীরে বললেন, 'ওহ! গোষ্ঠ পাল, মোহনবাগান আর পঙ্কজ রয়?' তারপরেই একটু ছোট করে, 'কেমন আছেন? ' শেষেরটা পুরো বাংলায়। দিলীপ কুমারের মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে অবাক হয়েছিলাম। ফোটোশুটের ফাঁকে ফাঁকে তিনি ব্যাপারটা বুঝিয়েও দিলেন। কলকাতা যে ফুটবলের পীঠস্থান, তাই গোষ্ঠ পাল আর মোহনবাগানের নাম নিয়েছিলেন। উপরন্তু তিনি নিজে নাসিকের দেওলালিতে থাকার সময় ফুটবলে অনুরক্ত হয়েছিলেন। পরে বোম্বের মাতুঙ্গায় খালসা কলেজে এসে ক্রিকেটেও।

একটু পরেই আবার মুখ খুললেন। হিন্দিতে উর্দু উচ্চারণ ভঙ্গি এনে বললেন, 'বাঙালিই তো আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমাকে ঘিরে থেকেছে। কেন বললাম বুঝলেন? আমার অভিনয় জীবন শুরুই হল বাঙালিদের উদ্যোগে। দেবিকারাণী, অশোক ভাইয়া (অশোক কুমার), এস. মুখার্জি (শশধর মুখোপাধ্যায়),  পরিচালক অমিয় চক্রবর্তী, যিনি আমার জীবনের প্রথম পরিচালক ('জোয়ার ভাটা')। আমাকে অভিনয় শিখিয়েছেন। দেবিকারাণী আর নীতিন বোস। ওঁরা দু'জনেই আমার অভিনয়ের প্রথম শিক্ষক। ১৯৪৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নৌকাডূবি' হিন্দিতে পরিচালনা করেছিলেন নীতিন দা। 'মিলন'। শুটিংয়ের আগে আমাকে একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি অরিজিন্যাল নভেলটা পড়েছি কিনা। আমাকে 'নৌকাডুবি'-র ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া হয়েছিল। পুরো নভেলটা পড়েছিলাম। আমার ক্যারেকটারের নাম ছিল 'রমেশ'। যে নিজের মায়ের চিতাভস্ম বারাণসীর গঙ্গায়  বিসর্জন দিতে আসছিল। এরকমই ছিল প্রথম দিনের শট।' অবাক হয়েছিলাম দিলীপ কুমারের প্রখর স্মরণশক্তি দেখে। 

 

 

সেদিন ফোটোশুটে আসতে দিলীপ যতটা সময় নিয়েছিলেন, প্রায় ততটা সময়ই তিনি ফোটোশুটে আর গল্পে কাটিয়েছিলেন। আবার শুটিংয়ের ব্রেকে বললেন, 'বিমলদা ( পরিচালক বিমল রায়), হৃষিদা (হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়)দের সঙ্গে কাজ করে ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। কী অসাধারণ পরিচালক ছিলেন ওঁরা। 'মুসাফির', 'মধুমতী'-র কথা মনে পড়ছে। দুজন বাঙালি এক জায়গায় হলে বাংলা কথার বন্যা বয়ে যেত। সেটা দেখেছি এস. মুখার্জি আর ওঁর শ্যালক অশোক কুমারের মধ্যে। ওঁদের সঙ্গেই তো জীবনের সবচেয়ে দামি দিনগুলো কাটিয়েছি। তাই বাংলাও কিছু কিছু শিখে ফেললাম। পরে তপনদার  ( পরিচালক তপন সিংহ) 'সাগিনা মাহাতো' করতে যখন  কলকাতা যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম, খুব ভাল লাগছিল। আর তপনদার ফিল্মে তো বাংলা ডায়ালগ নিজেই  বললাম। আর একটা বাংলা ফিল্ম করেছিলাম। 'পাড়ি'। ওখানেও কিন্তু বাংলা ডায়ালগ আমার নিজের বলা। ছবিটা প্রোডিউস করেছিল বোম্বেতে আমার অনেকদিনের বন্ধু গোবিন্দ। চিনতে পারলেন? ওর ভাল নাম অভি ভট্টাচার্য। এবার চিনতে পারলেন বোধহয় ?'

Share this article
click me!

Latest Videos

উপনির্বাচনে হার! কি বললেন শুভেন্দু! দেখুন #shorts #suvenduadhikari
ইয়ার্কি হচ্ছে! এতদিন ধরে বালু পাচার হচ্ছে আর উনি জানেন না! Mamata-কে তুলোধোনা Sukanta-র
Live : India vs Australia: রাহুল-যশস্বীর ব্যাটে জয়ের স্বপ্ন, অস্ট্রেলিয়া সফরের শুরুতেই দাপট
ভেঙে পড়ার কারন নেই! কেন BJP-র হার, জানালেন শুভেন্দু | Suvendu Adhikari | BJP News
রুগী মৃত্যু কে কেন্দ্র করে Doctor ও Nurse-দের উপর আক্রমণ, শুনুন সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা