দেবী চণ্ডিকার পূজারী দুর্গার পুজো হবে শুনে নিদান দেন, মূর্তি পুজো করা যাবে না। পটে এঁকে পুজো করা যেতে পারে। সেই থেকেই বর্ধমান রাজবাড়িতে শুরু হয়েছিল পটেশ্বরী দুর্গার পুজো।
বর্ধমানের মহারাজ তখন মহতাব চাঁদ। রাজপরিবারের কুলদেবী দেবী চণ্ডিকা। কথিত আছে, একবার রাজার ইচ্ছে হল রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো করার। সেই কথা কুল পুরোহিতকে গিয়ে তিনি জানালেন। চণ্ডিকার পূজারী দুর্গার পুজো হবে শুনে নিদান দেন, মূর্তি পুজো করা যাবে না। পটে এঁকে পুজো করা যেতে পারে। সেই থেকেই বর্ধমান রাজবাড়িতে শুরু হয়েছিল পটেশ্বরী দুর্গার পুজো।
আজ সেই রাজা নেই, রাজবাড়ির অবস্থাও এখন জরাজীর্ণ। তবু রাজপরিবারের সেই ঐতিহ্য এখনও বর্তমান। রাজার আমলে বর্ধমান রাজবাড়ি অর্থাৎ বর্তমানে যেটা বর্ধমান মহিলা কলেজ, সেখানে ছিল রাজবাড়ির দুর্গামন্দির। সেই মন্দিরে আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে পটেশ্বরী দুর্গার পুজো শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই মন্দির ভেঙে যাওয়ায় মাতৃ প্রতিমাকে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে প্রতিপদের দিন ঘট স্থাপন করা হয়, ১০দিন ধরে পুজো চলে। আগে দেবীকে ৫২ রকমের ভোগ নিবেদন করা হতো । এখন অষ্টমী এবং নবমীতে দেবীকে নৈবেদ্য হিসেবে লুচি ও হালুয়া নিবেদন করা হয়। দেবী দুর্গা এখানে শালকাঠের কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত। কাঠের কাঠামোর উপর নানা রঙের টানে গড়ে ওঠে দশভুজার পরিবার। এখানে একমাত্র গণেশ ছাড়া দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং অসুরের মুখ এমন ভাবে আঁকা আছে, যাতে শুধুমাত্র মুখের একটি পাশ দেখা যায়। মা দুর্গার বাহন সিংহের জায়গায় আঁকা হয় ঘোড়ার ছবি। পটেশ্বরী দুর্গা ১২ বছর অন্তর একবার রং করা হয়। কিন্তু কখনও দেবীপ্রতিমার রূপের কোনও পরিবর্তন করা হয় না।
রাজ আমলে ধুমধাম করে হত এই পটেশ্বরী দুর্গার পুজো। বহু মানুষের আগমন হত বর্ধমান রাজবাড়িতে। নদীর ওপার থেকেও বহু গ্রামের মানুষ পায়ে হেঁটে, গরুর গাড়িতে চড়ে আসতেন এই মন্দিরে পুজো দেখতে। জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পুজো হত এখানে। প্রত্যেকদিনই ভিড় লেগে থাকতো মন্দির প্রাঙ্গনে। তবে রাজ পরিবারের প্রথা অনুযায়ী অন্দর মহলের মহিলারা বাইরের লোকজনের সামনে আসতেন না। রাজবাড়ি থেকে গোপন রাস্তা দিয়ে তাঁরা প্রবেশ করতেন দুর্গামন্দিরের ভেতর। ইতিহাস বলছে, মন্দিরের দোতলায় বসে দর্শনির মাধ্যমে পুজো ও অনুষ্ঠান দেখতেন রাজপরিবারের মহিলারা। মন্দিরের ভেতরে থাকা মানুষজন রাজ পরিবারের মহিলাদের দেখতে পেতেন না। এখনও দুর্গাপুজোর সময়ে রাজবাড়ির মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। বর্তমানে মন্দিরের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে একটি ট্রাস্ট।
তবে এখন এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে বলে আক্ষেপ স্থানীয় বাসিন্দাদের। মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটার কারুকার্য, পলেস্তারা খসে পড়ছে। বর্ধমান রাজপরিবারের মন্দিরের মূল ফটকও দেখাশোনা অভাবে এখন ভগ্নপ্রায়। সময় বদলানোর সাথে সাথে জৌলুস হারাচ্ছে রাজপরিবারের পটেশ্বরী দুর্গার পুজো। কিন্তু রাজ ঐতিহ্য, আচার ও রীতিনীতি এখনও মজবুত। মহালয়ার পরের দিন থেকে বর্ধমানের মহারাজার মন্দিরে দুর্গাপুজো শুরু হয়। পুজোর সময় রাজপরিবারের এক মাত্র বংশধর প্রণয় চাঁদ মহাতাব সস্ত্রীক বর্ধমানে থাকেন এবং নিজে পুজোয় বসেন। তবে করোনা আবহে গতবছর তিনি আসেননি। এবারও আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলে জানালেন বর্তমানে এই মন্দিরের সেবাইত উত্তম মিশ্র। করোনার প্রকোপে পুজোর আয়োজনে কিছুটা ভাটা পড়েছে। শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার খাতিরেই পুজো হবে বলে জানালেন বর্তমান পুরোহিত।
মন্দিরে এখানও বলি প্রথা চালু আছে। তবে মেষ, মহিষ বা ছাগল বলি দেওয়া হয় না। রাজাদের আমলে সুপারি বলি দেওয়া হত। এখন অবশ্য সুপারি বলির জায়গায় চালকুমড়ো বলি হয়। অষ্টমীর দিন মা পটেশ্বরীর সামনে নবকুমারী পুজো হয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল নবমী নিশি, নবমীর রাতে গুজরাটি সম্প্রদায়ের মানুষজন নাটমন্দিরে ডাণ্ডিয়া নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন-
শাড়ি আলতা চন্দন এখন আর শুধু মেয়েদের দখলে নয়, মোহময় পুরুষের ছবি শেয়ার করে টুইটারে আবেগতাড়িত তসলিমা নাসরিন
অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ফের ৫ কোটির হদিশ! কোন পথে এগিয়েছে বাংলার শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি?
'মমতার সরকারের অত্যাচার ও হিংস্রতা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে', তোপ দাগলেন রবিশঙ্কর প্রসাদ