শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব পুজোর সময় ছড়রা গাড়িতে চেপে হাজির হয়েছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে। ইংরেজদের প্রতি কৃতজ্ঞ নবকৃষ্ণ দেবের এই পুজোতে ভক্তির তুলনায় বৈভব ছিল মূল আকর্ষণ।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সহায়ক ছিলেন নবকৃষ্ণ দেব। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের হার ও ইংরেজদের জয়লাভের পর পলাশির যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় রাখতে এবং দেশীয় মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রতিপত্তি বাড়াতে মহা ধুমধাম করে নবকৃষ্ণ দেব শুরু করেন দুর্গাপুজো। এর সঙ্গে ছিল অতিঅবশ্যই লর্ড ক্লাইভকে খুশ করার বিষয়টিও। কারণ, নবাব সিরাজ উদ দৌলার বিপুল অর্থের একটা ভাগ নবকৃষ্ণ পেয়েছিলেন। তাই ইংরেজদের প্রতি কৃতজ্ঞ নবকৃষ্ণের এই পুজোতে ভক্তির তুলনায় বৈভব ছিল মূল আকর্ষণ। বাঈজি নাচ থেকে ইংরেজদের বলড্যান্স সবকিছুতেই ছিল ইংরেজ তোষামোদের ছাপ স্পষ্ট। সেই শুরু তখন থেকে চলে আসছে ঐতিহ্যের এই পূজো। এবছর ২৬৬ বছরে পা দিল এই পুজো। লিখেছেন, সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার।
একবার শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব পুজোর সময় ছড়রা গাড়িতে চেপে হাজির হয়েছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে। আর এসেই তিনি মায়ের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেছিলেন ৷ রাজবাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব এসেছেন, এ কথা চাউর হতেই, লোকে লোকারণ্য হয়েছিল গিয়েছিল শোভাবাজার রাজবাড়ি।
ইতিহাস-
ইংরেজদের তোষামোদ আর চাতুর্যের জোরে যে জমিদারবর্গের উত্থান হয়েছিল শহর কলকাতার বুকে তার মধ্যে শোভাবাজার রাজবাড়ির নাম প্রথমের দিকে। নবকৃষ্ণের বাবা রামচরণ দেব ছিলেন কটকের দেওয়ান। সে সময়ে পিণ্ডারি দস্যুদের প্রবল উৎপাত। তা দমন করতে গিয়ে খুবই কম বয়সে মারা যান তিনি। নাবালক সন্তানদের নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন নবকৃষ্ণের মা। তখন তাঁদের বাস ছিল গোবিন্দপুরে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই নিজ চেষ্টা আর অধ্যবসায়ে তিনি রপ্ত করে নিলেন বেশ কিছু ভাষা। সংস্কৃত, ইংরাজি আর ফার্সিতে তুখোড় হয়ে উঠে এক সময়ে যোগ দিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ফার্সির শিক্ষক হিসেবে।কিন্তু এখানেই থেমে থাকার লোক ছিলেন না তিনি। যে কোনও উপায়ে যখন ইংরেজদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছেন, তখনই সুযোগ এল অপ্রত্যাশিতভাবে। ১৭৫৬ সালে সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করে দখল করে নিলেন। ইংরেজরা প্রাণভয়ে পালালেন ফলতায়। প্রায় মাস ছয়েক সেখানেই আটকে রইলেন তাঁরা।সেই সময়েই নিজের আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খাদ্য সরবরাহ করে ক্লাইভ-সহ অন্য ইংরেদের প্রাণ রক্ষা করলেন নবকৃষ্ণদেব। ইংরেজদের নেক নজরে পড়ার সেই শুরু।পলাশির যুদ্ধের পুরো সময়কালেই ইংরেজদের অন্যতম প্রধান সহায়ক ছিলেন তিনি। ক্লাইভও বিমুখ করেননি নবকৃষ্ণ দেবকে। যুদ্ধের পরে সিরাজের সম্পদ যথেচ্ছ লুঠ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই লুঠের মালের ভাগ পেলেন রাজা নবকৃষ্ণদেবও। সেই বছরই পলাশির যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে এবং দেশীয় মানুষের মধ্যে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রতিপত্তি বাড়াতে মহা ধুমধাম করে তিনি শুরু করলেন দুর্গাপুজো।
পুজো শুরু কখন থেকে-
১৭৫৭ সালে পুজো শুরু করলেন নবকৃষ্ণ। এত জাঁকযমক করে পুজো এর আগে কলকাতার মানুষ দেখেনি। শোভারাম বসাকের কাছ থেকে নবকৃষ্ণ প্রায় ১৪ বিঘা জমির উপরে বিরাট একটি বাড়িও কেনেন। শোভাবাজারের হোগলা বনে ঢাকা এলাকার জঙ্গল সাফ করে বসতি স্থাপন করেছিলেন শোভারাম। সেই বাসগৃহকে নবরূপ দিলেন নবকৃষ্ণ।নবকৃষ্ণদেব একেএকে তৈরি করলেন মনোরম ঠাকুরদালান, তোষাখানা, নহবৎখানা, নায়েব, গোমস্তা, কোষাধ্যক্ষ,পাইক-বরকন্দাজদের থাকার জায়গা, বিরাট বড় গোশালা, অশ্বশালা-সহ আরও অনেক কিছু। পলাশির যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ণ স্বরূপ মূল দরজার কাছে বসালেন কামান। নবনির্মিত নাচঘরে কাঁচের এমন ঝাড়বাতি লাগালেন যে ব্রিটিশ অফিসারদের অবধি চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।
পুজো পদ্ধতি-
রীতিমতো নিষ্ঠাভরে পুজো করলেন নবকৃষ্ণদেব।পুজোর বিধি তিনি নিয়েছিলেন কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সভাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কাছ থেকে। তর্কপঞ্চাননের পরামর্শমতো সাত্ত্বিক মতে পুজো হবে বলে ঠিক করেন তিনি। মনের মতো করে দেবীকে গড়লেন তিনি। মাথায় দিলেন সোনার মুকুট, হাতে সোনার অস্ত্র। চুলে সাজিয়ে দিলেন ২৬টি সোনার তৈরি স্বর্ণচাঁপা। প্রতিদিন নৈবেদ্যে দিলেন ৩০ মণ চাল। ধুপধুনো, ভোগের গন্ধে, মন্ত্রোচ্চারণে গমগম করতে লাগল বাড়ি। পুজোর দিনগুলিতে অকাতরে দানধ্যান করতেন নবকৃষ্ণদেব। কাঙালী ভোজন থেকে ব্রাহ্মণ বিদায়- সবই ছিল দেখার মতো।
আরও পড়ুন-
দক্ষিণ সুইডেনের হেলসিংবর্গের কনকনে ঠাণ্ডায় এই প্রথমবার তিথি মেনে দুর্গাপুজো, দুই বাংলার সমন্বয়ে নারীশক্তি
কেবলমাত্র কল্লোলিনী কলকাতা নয়, দিলওয়ালো কা দিল্লিতেও দুর্গাপুজো ছাড়িয়েছে একশো বছর, রইল সেরা মণ্ডপগুলির হদিশ
‘সিটি অফ জয়’ থেকে ‘সিটি অফ ড্রিমস’, দুর্গাপুজোর আমেজ স্বপ্নের মুম্বইতেও, জেনে নিন এখানকার পুজোর বিশেষত্বগুলি