শাড়ি বেচে সংসার চালিয়েছেন, হার মেনেছে ক্যান্সার! দেবীর আশীর্বাদে ‘জয়ী’ ভারতী চক্রবর্তী

আচমকাই ঘাড়ের কাছে শক্ত মাংসপিণ্ড। চিকিৎসকেরা ভুল করে যক্ষ্মার চিকিৎসা আরম্ভ করলেন! টানা ছ’মাস শুধুই যক্ষ্মার ওষুধ খেয়ে গেলেন ভারতী। তারপর...

ভারতী চক্রবর্তী, ক্যান্সারজয়ী প্রমীলা- ডিগ্রির জোর নেই। উপার্জন করতে গেলে কায়িক পরিশ্রম করতে হবে- বুঝেছিলেন ভারতী চক্রবর্তী। পাড়ার সবাই দেখতেন, এক মহিলা কাঁধে ইয়া বড় দুটো ব্যাগ চাপিয়ে দিনের বেলায় অফিসপাড়ায় শাড়ি বিক্রি করছেন। আবার সেই তিনি-ই তেলেভাজার দোকান দিয়ে নিজের হাতে চপ ভাজছেন। ভারতীর দশভূজা মূর্তি দেখে ভয় পেয়েছিল ক্যান্সারাসুরও! তার পর? মৃত্যুকে হারিয়ে জীবনে ফেরার গল্প শুনল এশিয়ানেট নিউজ বাংলা


বিধাননগর রোডের সিআইটি আবাসনের বাসিন্দা। সাল ১৯৮০। সাতপাক ঘুরেছেন যখন বয়স মাত্র ১৬!

Latest Videos

ভারতী চক্রবর্তী। শাশুড়ি, দেওর, জা নিয়ে ভরন্ত সংসার। কিন্তু স্বচ্ছল নয় যেমনটা স্বপ্ন দেখতেন। বরাবরই স্বামীর একা উপার্জনে টান পড়ত খরচে। এ দিকে নির্দিষ্ট সময়ে কোলজুড়ে এক মাত্র কন্যা সন্তান। ভারতীর তখন থেকে রাতের ঘুম উধাও। মা-বাবা ভাল করে জ্ঞান হওয়ার আগেই গত। বড়দি মায়ের সমান। উদ্বাস্তু ক্যাম্পে মানুষ। পড়াশোনা শিখতে পারেননি। তার আগেই বিয়ে। মেয়ে তাঁর মতো হেলাফেলায় বড় হলে চলবে না! 

ভারতী কেবলই ভাবেন আর উপায় হাতড়ান। কী করলে একটু আর্থিক সাশ্রয় হবে? মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পারবেন? এই দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম তাঁর চোখের পাতায় বসে না! শেষে ঠিক করলেন শাড়ির ব্যবসা করবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ভারতী বড় বাজারের একটি আড়ত থেকে শাড়ি তুললেন। তার পর ইয়া বড় দুটো ব্যাগে সব গুছিয়ে পা রাখলেন অফিস পাড়ায়। বাকিটা ভারতীর জবানিতে---

‘আমার বড়দির এক জা ফুড কর্পোরেশনে চাকরি করতেন। তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন তাঁর অফিসে। সব লজ্জা ঝেড়ে তাঁর সঙ্গে প্রথম পা রাখলাম অফিস পাড়ায়। সেই শুরু। জানতাম, ভয় পেলে বা লজ্জায় গুটিয়ে থাকলে কেউ অন্ন জোগাবে না। নিজের খিদে, নিজের খাবার নিজে বুঝে নিতে হবে। আমার পুঁজি বলতে মনের জোর। আর অসুরের মতো খাটনি। এই দুই শক্তিকে খুঁটি বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।’

ভারতীর কপাল ভাল, সে দিন শাশুড়ি, দেওর— সবাই তাঁর প্রয়োজন বুঝেছিলেন। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর। ব্যবসা বাড়াতে সারা দিন টালা থেকে টালিগঞ্জ ট- টো করতেন তিনি। দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেন। একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার ঘরের কাজ। ভারতীর নিজের দিকে তাকানোর, নিজের যত্ন নেওয়ার সময়ই নেই! এত পরিশ্রম কি বৃথা যায়? আস্তে আস্তে ব্যবসায় লাভের মুখ দেখতেই দ্বিগুণ উৎসাহ তাঁর। আরও বেশি শাড়ি। আরও বেশি অফিস। এ বার অফিস পাড়ার পাশাপাশি বাড়িতেও পৌঁছে যেতে লাগলেন ভারতী।  

ভারী ব্যাগ টানতে টানতে কাঁধ, হাতে ব্যথা শুরু হল। উপায় না দেখে জমানো অর্থ দিয়ে একটি খাবারের দোকান কিনে নিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘বরাবরই ব্যবসায়িক বুদ্ধি বেশি আমার। প্রয়োজনের বাইরে কোনও খরচ করতাম না। এ ভাবে সংসার চালিয়ে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। যখন দেখলাম, শরীর বিদ্রোহ করছে তখন বুদ্ধি করে দোকানটা কিনে নিলাম। বেলেঘাটা সিআইটি রোডের মতো জনবহুল এলাকা। কাছেই বেলেঘাটা শিশু হাসপাতাল। বুঝেছিলাম, খাবারের দোকান দিলে ভাল চলবে। কম পুঁজিতে এক মাত্র তেলেভাজার দোকান দেওয়া যায়। আমি ভাল রাঁধতে পারি। তাই নিজেই চপ ভাজার দায়িত্ব নিলাম।’ 

বড় বাজার থেকে শাড়ি তোলার পাশাপাশি আরও একটি কাজ বাড়ল ভারতীর। নিজের হাতে তেলেভাজার বাজার, আলু সিদ্ধ করা, মশলা বানানো, চপের আকারে গড়া— করতে হত তাঁকে। যদিও এত খাটনিতেও তাঁর আপত্তি নেই। লড়াকু নারীর কথায়, ‘আমি তো কোনও নোংরা কাজ করছি না!’ এ ভাবেই মেয়েকে স্নাতক পড়িয়েছেন। বিয়ে দিয়েছেন দাঁড়িয়ে থেকে। বিয়ে দিয়েছেন দেওরেরও। তাঁর বক্তব্য, আবাসনে সদ্য বেড়ে ওঠা মেয়েকে একা রেখে যেতে ভয়ই করত। নিজেই তাই মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন। ঘরে মেয়েকে রেখে দরকারে বাইরে থেকে তালা দিয়ে বেরোতেন।

সব দায়িত্ব সেরে সবে থিতু হয়েছেন ভারতী। আগের মতো খাটতে পারেন না। বয়স বাড়ছে। তুলনায় নিশ্চিন্তও। অবসরের কথা ভাবছেন। ফের জোর ধাক্কা। এত দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম, শরীরের অযত্ন— দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এল। আচমকাই ঘাড়ের কাছে শক্ত মাংসের পিণ্ড। ব্যথা নেই। কিন্তু অস্বস্তিজনক। ক্রমশ আকারে বাড়তেই সরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ তিনি। সেখানেও বিধি বাম। চিকিৎসকেরা ভুল করে যক্ষ্মার চিকিৎসা আরম্ভ করলেন! টানা ছ’মাস শুধুই যক্ষ্মার ওষুধ খেয়ে গেলেন ভারতী। অসুখ তাতে কি আর কমে?

এ বার চিকিৎসকদের নিদান, অস্ত্রোপচার করতে হবে। সেই অনুযায়ী ছুরি-কাঁচি ধরে তাঁরা দেখতে পেলেন, মস্ত ভুল! আসলে ক্যান্সার হয়েছে ভারতীর। শুনেই বাড়িতে কান্নাকাটি। স্বামী, মেয়ে, জামাই, দেওরদের মাথায় হাত। একা শক্ত ছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘সবাই এত ভেঙে পড়ছ কেন? দেখবে, লড়ে জিতে ফিরব।’ তাই-ই করেছেন। কেমো নিয়ে, ওষুধ খেয়ে, দিনের পর দিন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা করিয়েছেন। এমন দুর্দিনেও তাঁর সম্বল জেদ, সাহস আর মনের জোর। নিজের জমানো টাকা দিয়ে নিজের চিকিৎসা করিয়েছেন। কারওর কাছে হাত পাতেননি। মারণ রোগ তাঁর ইচ্ছাশক্তির কাছে মাথা নীচু করতে বাধ্য হয়েছে। এক যুগেরও বেশি সময় পার। কর্কট রোগ আর ভারতীর ধারপাশে ঘেঁষেনি। 

জীবন সবাই একটু সুখ চায়। ভারতী শুধুই সংগ্রাম করলেন। কোনও আফসোস? প্রশ্ন রেখেছিল এশিয়ানেট নিউজ বাংলা। লড়াকু নারী হাসিমুখে বলেছেন, ‘কে বলেছে শুধুই কষ্ট করেছি। তার মধ্যেও আনন্দ করেছি। বেড়াতে গিয়েছি। নিজের হাতে মেয়েকে বড় করে বিয়ে দেওয়া কম সুখের? আমি তো সেই কাজ অবলীলায় করেছি। আমার মতো সুখী ক’জন?’ পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের উদ্দেশেও বার্তা দিয়েছেন, ‘শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাইনি। তবু মনের জোরে ঠিক জিতেছি। তোমরা সবাই শিক্ষিত। তোমরা কখনও হেরে যাওয়ার আগে হারবে না। জেদ,সাহস,মনের জোর আর ইচ্ছেশক্তি থাকলে তোমরা আরও কঠিন লড়াই জিতে ফিরবে।’ 
অনুলিখন- উপালি মুখোপাধ্যায়, সাক্ষাৎকার সংগ্রাহক প্রতিনিধি- উপালি মুখোপাধ্যায় 
আরও পড়ুন- 
'শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই মুখ ফিরিয়েছিলেন, এখন সবাইকে ডেকে বলেন, নন্দিনী তো আমাদেরই বৌমা!' 
'কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাবা-কাকার মৃত্যু! একার দায়িত্বে সংসার ধরে রেখেছিলেন মা'- শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় 
Durga Puja 2022 : চেতলা অগ্রণীর মা দুর্গার চক্ষুদান করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 

Read more Articles on
Share this article
click me!

Latest Videos

Bangladesh-এ এবার চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ভক্তদের উপর আক্রমণ, গর্জে উঠে যা বললেন Suvendu Adhikari
Chinmay Krishna Das-কে দেখা মাত্রই 'জয় শ্রী রাম' ধ্বনিতে মুখরিত চট্টগ্রাম কোর্ট চত্বর, দেখুন ভিডিও
'Firhad Hakim ও Kalyan Banerjee কে ফের একবার তীব্র আক্রমণ Humayun Kabir-এর, দেখুন কী বললেন
Suvendu Adhikari Live: সাংবাদিক বৈঠকে শুভেন্দু, কী বার্তা, দেখুন সরাসরি
কলকাতার রাজপথে ফের প্রতিবাদের মশাল মিছিল! প্রভু চিন্ময়ের মুক্তির দাবিতে চললও বিক্ষোভ মিছিল