সংক্ষিপ্ত
নন্দিনী ভৌমিক। বাঙালির ঘরে ঘরে এখন এক পরিচিত নাম। পশ্চিমবঙ্গে এই সময়ে তিনি এক প্রথা ভেঙে লাইম লাইটে। কিন্তু, এই সফরের আগে তাঁর জীবন জুড়ে ছিল এক অসামান্য লড়াই-এর গল্প। সেই কাহিনি আজও সকলকে মুগ্ধ করে। এশিয়ানেট নিউজ বাংলার জয়ং দেহি বিভাগে কলম ধরলেন নন্দিনী। শোনালেন নিজের একান্ত কাহিনি।
মেয়েদের লড়াইয়ের ষেন শেষ নেই। ছক ভেঙে কিছু করতে চাইলেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হা-রে-রে-রে। নারী কি তাতে দমে? ধারালো তরবারির মতোই সব বাধা কাটতে কাটতে এগিয়ে চলে। একটাই বীজমন্ত্র তার, জয়ং দেহি। কাঙ্খিত জয় আসে? কতটা লড়াইয়ের পর? শারদীয়ার আগে সেই জ্যান্ত দুর্গাদের মুখোমুখি এশিয়ানেট নিউজ বাংলা। তাঁদেরই একজন নন্দিনী ভৌমিক। বাংলার প্রথম মহিলা পুরোহিত তিনি।
জিতে ফেরার এক গল্প---
বাবা গৃহী সন্ন্যাসী... জীবনটাই বদলে গেল। আমি পুরোহিত হব। ছোট থেকেই বুঝি ভেবেছিলাম? তা নয়। খুব যে সচেতন ভাবে এই পেশায় এসেছি, সেটাও না। তবে ছোট থেকে দেখেছি, আমার বাবা যেন অন্য ধারার। নিয়মিত যোগাভ্যাস করতেন। গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। একটা সময়ের পরে আমার বাবার ধীরে ধীরে গৃহী সন্ন্যাসীর জীবনযাপন শুরু করলেন। চোখের সামনে দেখলাম, গৃহীর পোশাক ছেড়ে গেরুয়া ধরলেন। মাছ, মাংস ছেড়ে নিরামিষ খেতে শুরু করলেন। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। সেটা আরও কঠোর, কঠিন। পরিবারের সঙ্গে থেকে সন্ন্যাসী জীবন যাপন কি সবাই পারেন?
বাবার এই পরিবর্তন আমায় অনুপ্রাণিত করেছিল। একই সঙ্গে মনে ছাপও ফেলেছিল। কারণ, আমি আগাগোড়া বাবা অন্তপ্রাণ। তিনি আমার আদর্শ। তিনি পুজো করছেন, দীক্ষা দিচ্ছেন, সাধারণ মানুষদের আধ্যাত্মিকতা বোঝাচ্ছেন— এটা দেখতে দেখতেই বড় হওয়া। এবং একটু পরিণত হওয়ার পর বাবার কাজকর্ম উপলব্ধি করতে পারলাম। সঙ্গে যুক্ত হল আমার সংস্কৃত ভাষার প্রতি আকর্ষণ। সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা। সঙ্গে ভারত তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা। সেই কাজ করতে করতে দেখলাম, পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজে বদল চাই। প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে সেই সময়ের নির্যাস ছেঁকে নিয়ে তাতে আধুনিকতার প্রলেপ দিতে হবে। প্রয়োজনে এই যুগে যা অপ্রয়োজনীয় তা নির্দ্বিধায় ছেঁটে ফেলতে হবে। এটাই কেউ করছিল না। আমার এই ভাবনা তখন বাবার কাছে তুলে ধরি। আলোচনাও করতে থাকি। বাবা সম্মতি দেন। পৌরহিত্যে আমার যাত্রা শুরু।
সামারি বা প্রেসি করে দিন! কখন অঞ্জলি হবে?
বাবাকে বোঝানো যত সহজ সমাজ বা সাধারণ মানুষকে বোঝানো ততটাই কঠিন! তার উপরে আজকের প্রজন্ম পুরোহিতদের সম্মানই করে না। উল্টে ধমকায়, ‘‘সামারি করে দিন। প্রেসি করে দিন! আর কখন অঞ্জলি হবে?’’ কোনও কিছুর অর্থ জানে না। মন্ত্রর মানে বুঝতে পারে না। ফলে, পুজো পদ্ধতি নিয়েও আগ্রহ নেই। পুরোহিতদেরই দায়িত্ব, তাদের সবটা বুঝিয়ে দেওয়া। সবাইকে বিষয়টি বোঝাতে বোঝাতেই আমার অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। তখনই মনে হল, পুরনো ঐতিহ্যকে বজায় রেখে গান আর মন্ত্র পরপর সাজিয়ে চিত্রনাট্য লিখি। তার পর যদি সেটা মঞ্চে পারফর্ম করার মতোই কিছু করি, কেমন হয়? আমার সেই ভাবনার ফলাফল, আজকের এই তুমুল ব্যস্ততা। কাজের চাপে এতটাই হিমশিম যে এ বছর আমায় নতুন আরও তিনটি মহিলা পুরোহিতের দল খুলতে হয়েছে!
ব্রেসিয়ারের ফিতে... মহিলা পুরোহিতের পৈতে!
মহিলাদের অন্তর্বাসের ফিতে বেরিয়ে গেলে এই কটাক্ষ হামেশাই শুনতে হয়। শুনেছি, মহিলা পুরোহিতদের দিয়ে বিয়ে, পুজো শুরু করতেই নাকি তাঁদের পুরুষ পুরোহিতদের এই কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছিল। আমায় যদিও কোনও পুরুষ পুরোহিত এই ধরনের মন্তব্য করার সাহস দেখাননি। তবে এ কথা শুনিয়েছেন, আমি ঘোর পাপাচারী! বিরাট বড় পাপ করছি। আমার এই পাপের জন্য সমাজ রসাতলে যাবে। মেয়ে হয়ে নারায়ণ শিলা স্পর্শ করছি। ওঁম উচ্চারণ করছি। বেদ পাঠ করছি। পুজো দিচ্ছি। বিয়ে দিচ্ছি। এ ঘোর অনাচার! নারীদের যা যা নিষিদ্ধ তাই-ই অবলীলায় করে চলেছি! আমার পাল্টা প্রশ্ন, তা হলে সংস্কৃত-র স্নাতকোত্তর পঠনপাঠনে বেদের উপরে ১০০ নম্বরের একটি পেপার রয়েছে কেন? পড়াশোনায় দোষ নেই! তাকে ব্যবহারিক কাজে লাগালেই যাবতীয় সমস্যা?
আমার মতে, যোগ্যতাটাই আসল কথা। পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সততা দিয়ে যে কাজ করা যায় সেটিই মূল্যবান। বহু পুরুষ পুরোহিত কিন্তু এই পরিশ্রম করেন না। বিড়বিড় করে নিজের মতো মন্ত্রোচ্চারণ করেন। কেউ কিচ্ছু শুনতেও পান না। বুঝতেও পারেন না। বরং এতে আমাদের ভীষণ সুন্দর ধর্মীয় ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হয়। পুরোহিতদের কাছে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন। তাঁদের কাছে কিন্তু সঠিক জবাব নেই। অনেকেই শুদ্ধ উচ্চারণও করতে পারেন না। বরং আমাদের এই কাজ অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে। শুনেছি, আমাদের কাজ দেখে ইদানীং পুরুষ পুরোহিতদের বহু জন নানা বিষয়ে প্রশ্ন করছেন, ঠাকুরমশাই এটা একটু বুঝিয়ে দেবেন? ভাল লাগছে।
ওই কটা দিন শরীর ভাল থাকে... চোখ বন্ধ করে পুজো করো
মাসের ক’টা দিন নারী অচ্ছুৎ! পুরুষ যত না বলে, নারী তার থেকেও বেশি মানে। নিজেই নিজের পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছে। আমার এক ছাত্রী ক্লাসের পরে আমায় বাধো বাধো গলায় জানতে চেয়েছিল, ‘‘তা হলে ম্যাম, শরীর খারাপ নিয়েই দুর্গাপুজোর অঞ্জলি দিতে পারব?’’ আমি অবাক, কেন নয়! চোখ বন্ধ করে পুজো দাও। কোনও পাপ হবে না। আর ক্যালেন্ডারে ওই ক’টি দিন দাগিয়ে রাখো ‘শরীর ভাল থাকা’র দিন হিসেবে। ঋতুস্রাব না হলেই বরং চিকিৎসকের কাছে দৌড়োতে হবে! মেয়েটি আরও কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘‘আমার বাবা এই কথাই বলছেন। কিন্তু আমার মা ভীষণ কড়া! কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।’’
আমার পরিবার, আমার মা-বাবা এ রকমই মুক্তমনা। আমি তাঁদের মেয়ে। তাঁদের শিক্ষায় বেড়ে উঠেছি। তাই আমার বিশ্বাস, দিনে একটিও মিথ্যে বললে সে দিন আর ঠাকুর ঘরে ঢোকা উচিত নয়। কারণ, সে দিন আমি প্রকৃত পাপ করেছি। সে দিন বরং পুজো করলে ঈশ্বর রুষ্ট হবেন। আর আমাদের বাড়িতে ঈশ্বরের আরাধনাই এক মাত্র পুজো নয়। পড়াশোনা, নিত্য দিনের কাজ, গান-বাজনা— সবটাই দেবতার সাধনা। মাসের ওই ক’টা দিন ও গুলো তো বন্ধ যায় না! তা হলে ঋতুস্রাবে কেন ঠাকুর পুজো বন্ধ যাবে? আমার মা-বাবা এ ভাবেই ভাবতে শিখিয়েছেন। আমিও সেই ভাবনাই সবাইকে শেখাতে চাইছি।
ও তো আমাদের বাড়ির বৌমা....
আজ যত সহজে সবাই সব কিছু বোঝেন বা বোঝার চেষ্টা করেন তত সহজেও সবটা হয়নি। প্রচুর বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, পুরুষ পুরোহিত—কেউ সমর্থন জানাননি। এমনও হয়েছে, বিয়ে দিয়ে উঠেছি। বাড়ির লোক পুরুষ পুরোহিত দিয়ে কন্যা সম্প্রদান, গোত্রান্তর ইত্যাদি যে গুলো আমি বাদ দিয়েছি সে গুলো পালন করেছেন। বিয়ের ষজ্ঞের আগুনে খই ফেলা নিয়েও বিতণ্ডা হয়েছে। মেয়ের বাড়ির টাকায় কেনা খই কেন যজ্ঞে ফেলাচ্ছি! এটা যে ঘোর অমঙ্গল। যিনি বলেছেন তাঁরও দোষ নেই। সমাজ তাঁকে এই ভুল নিয়ম শিখিয়েছে।
মা-বাবা পাশে ছিলেন। কিন্তু পরিবারের বাকিরা? পড়শি, সমাজ? তাঁরাও কি এত সহজে মেনে নেওয়ার বান্দা! কেউ কেউ তো আমায় স্বীকারই করতে চাননি। আমার জনপ্রিয়তা দেখে এখন তাঁরাই সবাইকে বলেন, নন্দিনী তো আমাদের বাড়ির বৌমা! তবে আমার স্বামী বরাবরই ভয়ে ভয়ে থাকতেন। কখনও, কোনও কিছুতে বাধা দেননি। কিন্তু আমি যদি বিপদে পড়ি! এই আশঙ্কায় ভুগতেন। আমি শুরু থেকেই তাই কখনও বিরোধিতায় যাইনি। জানি, স্রোতের বিপরীতে চলছি। তাই লড়াই করিনি। বিনয়ী হয়েছি। যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। প্রচুর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করেছি। নিজে সব গুছিয়ে লিখেছি। মানে বোঝানোর জন্য সংস্কৃত মন্ত্রের বাংলা করেছি। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি গান। অনেকেই হয়তো জানেন, বৈদিক যুগেও কিন্তু পুজোপাঠের সময় গান হত। যাকে আমরা সাম গান বলে জানি। প্রতিটি মন্ত্র তাই সুরে বাঁধা। আর অকারণ কিছু নিয়ম ছেঁটে দিয়েছি। যেমন, কন্যা সম্প্রদান, গোত্রান্তর, সিঁদুর দান। আপনারাই বলুন, কয়েকটি মন্ত্র পড়ে একটি মেয়েকে কখনও দান করে দেওয়া যায়? না তার গোত্র বদলে ফেলা যায়! দুটো মানুষ যখন নতুন জীবন আরম্ভ করতে চলেছেন তার প্রভাব দু’জনের উপরে সমান ভাবে পড়া উচিত। তাই সিঁদুরদানের পরে কনে তাঁর সিঁথি থেকে সিঁদুর নিয়ে পাত্রের কপালে পরিয়ে দেন তিলক চিহ্ন রূপে। ঠিক যে ভাবে, যুদ্ধে যাওয়ার আগে রানি রাজার কপালে এঁকে দিতেন বিজয় তিলক। আর বিয়ের শেষে দুই পক্ষের মা-বাবাকে ডাকি। তাঁরা মন্ত্রোচ্চারণ করে আশীর্বাদ করেন নবদম্পতিকে। মা বিয়ে দেখলে অমঙ্গল হয়, এই কুসংস্কার মুছতে।
এই নিয়েও মজার ঘটনা আছে। আমায় এক পাত্রের বাবা অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তাঁরা সব নিয়ম মেনে নেবেন। আমাকেও কন্যা সম্প্রদান, গোত্রান্তরের আচার পালন করতে হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম, অবশ্যই করব। তবে তার আগে আপনার ছেলের সম্প্রদান আর গোত্রান্তর করে নেওয়ার জন্য একটু সময় দেবেন! তাঁরা চুপ। আমায় চোখে বিয়ের অর্থ সমতা। সেখানে কোনও লিঙ্গ বৈষম্য আসতে দেব না। নিজের পরিবার থেকে বিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। দুই মেয়ের বিয়ে আমিই দিয়েছি। আমার প্রতিষ্ঠানের মেয়েদের নিয়ে পারলৌকিক ক্রিয়া, বিয়ে, অন্নপ্রাশন মিলিয়ে প্রচুর কাজ করেছি। ওম সাহানি-মিমি দত্তের সাতপাক আমার হাতে! ইদানীং অনেক তারকারাই ভাবছেন আমায়।
ভেবেছিলাম, এত সামলে পুজোটা আর করব না। ঈশ্বরের অন্য ইচ্ছে। গত বছর ৬৬ পল্লি আঠার মতো লেগে ছিল। নাছোড়বান্দার মতো আমায় দিয়েই পুজো করিয়েছে। এ বছরও ওই পুজো কমিটির পুজো আছে। এ ছাড়াও, দুর্গাপুজো, কালীপুজো মিলিয়ে বেশ কয়েকটি পুজোর দায়িত্ব আমার কাঁধে। ১০ বছর আগের দিনগুলোর দিকে তাকালে এখন বেশ লাগে। কিছুটা হলেও তো বদলাতে পেরেছি। বিশ্বাস, আগামি দিনে আরও পারব। কী বলেন আপনারা, শেষমেশ জিতেই গেলাম?
অনুলিখন- উপালি মুখোপাধ্যায়, সাক্ষাৎকার সংগ্রাহক প্রতিনিধি- উপালি মুখোপাধ্যায়
আরও পড়ুন-
দেবী দুর্গার অষ্টত্তরো শতনাম, যা কাটাবে জীবনের সকল ঝঞ্ঝাট ও সমস্যা
দুর্গাপুজোর সামগ্রী রাখতে মেনে চলুন বাস্তু মত, জেনে নিন কোন দিকে কী রাখা শুভ
দেবী দুর্গার অষ্টত্তরো শতনাম, যা কাটাবে জীবনের সকল ঝঞ্ঝাট ও সমস্যা