নীলমণি ঠাকুরের আমলে দুর্গাপুজো শুরু হলে ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ধুমধাম শুরু দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলেই

দ্বারকানাথ হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও পুজোর ক’দিন সন্ধ্যারতির সময় ঠাকুরদালানের সামনে পুত্রদের নিয়ে উপস্থিত থাকতেন। দরজা বন্ধ করা পাল্কিতে করে বিসর্জনের দিন মাতৃপ্রতিমার সাথে ঠাকুরবাড়ির বাড়ির মেয়েবউরাও গঙ্গার ঘাট অবধি যেত। ঠাকুরবাড়ির অজানা কথায় অনিরুদ্ধ  সরকার। ফিরে দেখা ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো। 

Asianet News Bangla | Published : Oct 9, 2021 1:06 PM IST / Updated: Oct 10 2021, 10:36 AM IST

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো হয় নীলমণি ঠাকুরের (Nilmani Tagore) আমলে। নীলমণি ঠাকুরের কন্যা কমলমণি লিখছেন, "১৭৮৪ সাল নাগাদ নীলমণি ঠাকুর জোড়াসাঁকোয় গোলপাতার একটি ঘর করে বসবাস শুরু করেন। তখন জোড়াসাঁকোর নাম ছিল মেছুয়াবাজার। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রথম দুর্গাপূজা শুরু হয় উনার আমল থেকে।" দ্বারকানাথ ঠাকুরের (Dwarakanath Tagore) আমল থেকে জোড়াসাঁকো (Jorasanko) ঠাকুরবাড়িতে ধূমধাম করে দুর্গাপুজো (Durga Puja) শুরু হয়। তাঁর আমলেই ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো, সরস্বতীপুজো অনুষ্ঠিত হত। তবে যেহেতু দ্বারকানাথ নিজে ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন, তাই পুজোয় বলি হত না। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (Satyendranath Tagore) এক লেখায় লিখছেন, “আমাদের বৈষ্ণব পরিবারে কী ভাগ্যি পশুবলির বীভৎস কাণ্ড ছিল না সেই রক্ষা,- পশুর বদল কুমড়ো বলি হয় এই শুনতুম।”  তখনকার সংবাদপত্রে দ্বারকানাথের পুজোপাঠের বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হত। তেমনই একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল এই মর্মে “শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহিত রামমোহন রায়ের আত্মীয়তা আছে কিন্তু রায়জী তাঁহার নিত্যকর্ম কিছুই রহিত করাইতে পারিয়াছেন তাহা কখনই পারিবেন না। ওই বাবুর বাটিতে দুর্গোৎসব, শ্যামপূজা, জগদ্ধত্রী পূজা ইত্যাদি তাবৎ কর্ম হইয়া থাকে।”

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (Dwarakanath Tagore) একজায়গায় লিখছেন “প্রথম বয়সে উপনয়নের পর প্রতিনিয়ত যখন গৃহেতে শালগ্রাম শিলার অর্চনা দেখিতাম, প্রতি বৎসর যখন দুর্গাপূজার উৎসবে উৎসাহিত হইতাম তখন মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রাম শিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।” ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজোর শুরুবাদ যেই করুন না কেন, দ্বারকানাথের আমলে পুজোর জাঁকজমক যে বৃদ্ধি পেয়েছিল সেবিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। শোনা যায়, দ্বারকানাথ হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও পুজোর ক’দিন সন্ধ্যারতির সময় ঠাকুরদালানের সামনে পুত্রদের নিয়ে উপস্থিত থাকতেন। ঠাকুরবাড়ির প্রতিমা গড়ার মাটি আসত গঙ্গার পাড় থেকে। উন্মুক্ত ঠাকুরদালানে চলত ঠাকুর তৈরির কাজ, অর্ধচন্দ্রাকৃতির একচালার মূর্তিই ছিল ঠাকুরবাড়ির পুজোর বৈশিষ্ট্য। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির (Jorasanko Thakurbari) দুর্গাপুজোয় মায়ের ভোগ ছিল দেখার মতো। দু’বেলা অন্ন থেকে মিষ্টান্ন সব মিলিয়ে একান্ন রকমের পদ মা’র ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হত, সাথে থাকত ফল, ডাবের জল এসব। পরে সেগুলি পুজোর দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হত। 

আরও পড়ুন- Durga Puja 2021: বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপুজোর সূত্রপাত স্বামীজীর হাত ধরে

ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোতে (Durga Puja) সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা আমন্ত্রণ পেতেন। আমন্ত্রণপত্রে লেখা হত দ্বারকানাথের পিতা রামমণি ঠাকুরের (Rammoni Thakur) নামে। একবার দেবেন্দ্রনাথ পিতামহের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের (Rammohan Roy) কাছে। দেবেন্দ্রনাথের বয়স তখন সবে বারো ছুঁয়েছে। ছোট্ট দেবেন ঠাকুর রামমোহনকে গিয়ে বলল,” সামনে পুজো তাই তিনদিনই প্রতিমাদর্শনে আপনার নিমন্ত্রণ, পত্রে দাদুর এই অনুরোধ।” প্রতিমাপুজোয় বিরোধী  রামমোহন পুত্তলিকাপুজোর বিরোধী ছিলেন। তিনি আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে খুব বিস্মিত হলেন। বন্ধু দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে খুব স্নেহ করতেন তাই নিমন্ত্রণপত্রটি প্রত্যাখ্যান করেননি আবার সরাসরি সেটি গ্রহনও করেননি, তিনি তাঁর ছেলে রাধাপ্রসাদের কাছে দেবেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিলেন। রাধাপ্রসাদ পিতার হয়ে ঠাকুরবাড়িতে গেছিলেন পুজো দেখতে। 

জোড়াসাঁকোর (Jorasanko) ঠাকুর পরিবারের দুর্গাপুজোর (Durga Puja) টুকরো টুকরো অনেক লেখা পাওয়া যায় অবনীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিম্বা সত্যেন্দ্রনা‌থ ঠাকুরের (Satyendranath Tagore) লেখায়। পুজোর সময় ঠাকুরবাড়ির উঠোনে খাটানো হত শামিয়ানা। তিন দিন ধরে বসত সঙ্গীতের আসর। হত যাত্রা। সঙ্গে থাকত 'সঙ'। পরিবারের সদস্য ছাড়াও আত্মীয়স্বজন এবং বাড়ির কাজের লোকদেরও নতুন জামাকাপড় দেওয়া হত। পুজোর আগে থেকেই দক্ষিণের বারান্দায় দেখা যেত নানা মানুষের ভিড়। জুতোর মাপ নিতে মুচি আসত চিনে পাড়ার থেকে। ছেলেদের জামার মাপ নিতে আসত আবদুল দর্জি। ছেলেদের জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ ছিল একটি চাপকান, জরি দেওয়া টুপি আর রেশমি রুমাল। আর আসত আতরওয়ালা। সে এলে ছেলেরা খুব খুশি হত কারণ আতরওয়ালার কাছ থেকে ছোটোরা পুজো উপলক্ষ্যে পেত এক শিশি করে আতর। বাড়ির মহিলামহলে আসত তাঁতিনীরা। তারা নিয়ে আসত হরেক রকমের শাড়ি। নীলাম্বরী, গঙ্গাযমুনার মত কত কি তাদের নাম। পুজোর ক’দিন মহিলারা বিভিন্ন ধরনের সোনার গয়না পরতেন।

আরও পড়ুন- Durga Puja 2021: ৩২ কেজি রুপোর গয়নার সঙ্গে গুজরাটি খাগড়ায় সাজছে সপরিবার দুর্গা

রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (Satyendranath Tagore) সেকালের ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে একটি লেখায় লিখছেন, "দালানে গিয়ে সন্ধ্যার আরতি দেখতুম, তাদের ধূপধুনা বাদ্যধ্বনির মধ্যে আমরা ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম, এত বাহ্য আড়ম্বরের মধ্যে এই যা ভিতরকার একটি আধ্যাত্মিক জিনিস ছিল।”ঠাকুরবাড়ির বিসর্জন নিয়ে সেযুগে প্রচলিত ছিল নানান গল্প। অবনীন্দ্রনাথ  (Abanindranath Tagore) লিখেছেন, “ বিজয়া ছিল আমাদের খুব আনন্দের দিন। সেদিনও কিছু কিছু পার্বণী মিলত। আমাদের বুড়োবুড়ো কর্মচারী যাঁরা ছিলেন যোগেশদাদা প্রভৃতিকে আমরা পেন্নাম করে কোলাকুলি করতুম। বুড়ো বুড়ো চাকরাও সব এসে আমাদের টিপটিপ করে পেন্নাম করত। তখন কিন্তু ভারি লজ্জা হত। খুশিও যে হতুম না তা নয়। কর্তামশায়কে কর্তাদিদিমাকে এ বাড়ির ও বাড়ির সকলেই প্রণাম করতে যেতুম। বরাবরই আমরা বড়ো হয়েও কর্তামশায়কে প্রতিবছর প্রণাম করতে যেতুম। তিনি জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘আজ বুঝি বিজয়া’।”

ঠাকুরবাড়িতে প্রতিবছরই ঘটা করে অনুষ্ঠিত হত ‘বিজয়া সম্মিলনী’ (Bijaya)। এপ্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ বিজয়া সম্মিলনীতে আমাদের বাড়িতে বসত মস্ত জলসা। খাওয়া দাওয়া, আতরের সুগন্ধ, পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ি ছিল। ঝাড়বাতি জ্বলত। ওস্তাদ তানপুরায় সুর ধরতেন। আর গানে গানে মাত করে দিতেন।” ঠাকুরবাড়ির বিসর্জিনের শোভাযাত্রা দেখতে ভিড় জমাতো প্রচুর লোক। দশমীর দিন নানা রকমের বাদ্যি আর গ্যাসবাতি নিয়ে এগিয়ে যেত বিসর্জনের শোভাযাত্রা। বাড়ির কাছেই যেহেতু গঙ্গা ছিল সেকারণে মাতৃপ্রতিমার সাথেসাথে বাড়ির মেয়েবউরাও গঙ্গার ঘাট অবধি যেত। তারা যেত দরজা বন্ধ করা পাল্কিতে করে। বাড়ির উমাকে বিদায় দিয়ে ছলছল চোখে ফিরে আসতেন তারা। গঙ্গার ঘাটে  আওয়াজ উঠত "আসছে বছর আবার হবে"। এই পুরো শোভাযাত্রায় যাতে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা না হয় সেকারণে শোভাযাত্রার সাথে যেত প্রহরীরা। যাদের হাতে থাকত পিতলে বাঁধানো লাঠি।

আরও পড়ুন- Durga Puja 2021: করোনা সংক্রমণ রুখতে দুর্গাপুজোয় নয়া নির্দেশিকা জারি করল কলকাতা পুলিশ

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Debendranath Tagore)  জ্যেষ্ঠা কন্যা, সৌদামিনী দেবী (Soudamini Devi) এক লেখায় লিখছেন, " বিজয়ার (Bijaya)দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন ।তারা বিজয়ার দিনে নতুন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে চলিত আমরা মেয়েরা সেইদিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম। তখন বৎসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম।” ঠাকুরবাড়ির পুরোনারীদের বিসর্জনে যাওয়ার  স্বাধীনতা দেওয়া নিয়ে নানাজায়গায় আলোচনা হত। দেবেন্দ্রনাথের পিসতুতো ভাই চন্দ্রমোহন একদিন দেবেন ঠাকুরকে এবিষয়টি জানাতে আসেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “দেখো দেবেন্দ্র, তোমার বাড়ির মেয়েরা বাহিরের খোলা ছাদে বেড়ায়। আমরা দেখিতে পাই, আমাদের লজ্জা করে। তুমি শাসন করিয়া দাও না কেন?” দেবেন ঠাকুর সব শুনলেন মন দিয়ে  কিন্তু এ ব্যাপারে বাড়ির মেয়েদের কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেননি কখনও।

ঠাকুরবাড়ির প্রতিবেশী ছিল জমিদার শিবকৃষ্ণ দাঁ। তাদের বাড়িতেও দুর্গাপূজো হত ধূমধাম করে। আর তাদের প্রতিমার গায়ে শোভা পেত বহুমূল্যবান গয়না। প্রতি বছর দ্বারকানাথের বাড়ির সামনে দিয়েই গা-ভর্তি গয়না পরে প্রতিমা যেত বিসর্জনে। সেযুগে একটি প্রবাদ লোকের মুখেমুখে ফিরত, "মা দুর্গা কৈলাস থেকে মর্তে এসে শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে গয়না পরতে যান।" লোকমুখে প্রচলিত এই প্রবাদ  দ্বারকানাথের (Dwarakanath Tagore) কানে গেল। সঙ্গে লাগল আভিজাত্যে। তো দ্বারকানাথ ঠিক করলেন তিনি দাঁবাড়ির সঙ্গে প্রতিমার গয়নায় টেক্কা দেবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তিনিও প্যারিস থেকে বহুমূল্যবান গয়না আনিয়ে তা প্রতিমাকে পরালেন। এখানেই শেষ না। বিসর্জনের আগে দাঁ'বাড়ির দুর্গা (Durga Maa) প্রতিমার গয়না তারা খুলে রাখতেন কিন্তু দ্বারকানাথ নির্দেশ দিলেন, বহুমূল্য গয়না সমেত প্রতিমাকে বিসর্জন দিয়ে দিতে। দেওয়াও হল তাই! দুর্গোৎসবে আভিজাত্যের লড়াইয়ে শেষ অবধি জয় হল ঠাকুরবাড়িই। 


 

Share this article
click me!