পেতলের টিকিট দেখিয়ে চোরবাগানের শীল বাড়ি থেকে টাকা পেতেন গরীব-দুখীরা, জেনে নিন সেই বাড়ির দুর্গাকথা

ঈশোপনিষদের মতাদর্শকে সামনে রেখে রাজা রামমোহন রায়ের পুতুলপূজা বর্জনের যুগে শীলবাড়ির প্রাণপুরুষ রামচাঁদ শীল ও তাঁর সহধর্মিনী ক্ষেত্রমণিদেবী এই দেবী দুর্গার পুজো শুরু করেন।  

Web Desk - ANB | Published : Sep 30, 2022 10:00 AM IST / Updated: Oct 07 2022, 11:45 AM IST

মুক্তরাম বাবু স্ট্রিটে মার্বেল প্যালেসের ঠিক পরেই শীলদের ঠাকুরবাড়ি। পুজো দেড়শো বছর ছাড়িয়েছে। কলকাতার পুরনো দুর্গোৎসবগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। লিখেছেন,  সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার। 

ইতিহাস-
এ পরিবারের প্রাণপুরুষ রামচাঁদ শীল ৷ হুগলির ঘুটিয়া বাজারে থাকতেন রামচাঁদ ৷ বাবা হলধর শীলের অবস্থা ভাল না থাকায় মা রেবতীমণির সঙ্গে চন্দননগরের মামার বাড়িতে চলে এসেছিলেন রামচাঁদ ৷ এখানেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা ৷ পরে মাসতুতো ভাই মদনমোহনের সহায়তায় গ্ল্যাডস্টোন কোম্পানিতে চাকরি পান রামচাঁদ ৷ তবে রামচাঁদ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কর্মনিষ্ঠ ও সুদক্ষ ৷ তাই সহজেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নেক নজরে পড়েন তিনি ৷ ওই কোম্পানিরই বেনিয়ান নিযুক্ত হন। ধীরে ধীরে কলকাতায় স্থাপন করেন বসতবাড়ি, ঠাকুরবাড়ি, প্রতিষ্ঠা করেন কুল দেবতা দামোদর জিউ-র ৷ শুরু করেন দোল-দুর্গোৎসব ৷ কিন্তু বিত্তশালী হওয়ার পরেও কোনওদিন নিজের অতীত ভুলতে পারেননি রামচাঁদ ৷ আর্ত মানুষের শুকনো মুখ তাঁকে আজীবন পীড়া দিয়েছিল ৷ তাই চোরবাগানের শীলবাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন গরীব-দুঃখী, অভাবী মানুষদের জন্য। নিজের উইলেও ১০০ টাকা পরিচারিকার জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন ৷ লোকমুখে প্রচলিত আছে, রামচাঁদ শীল নাকি নিজের পারলৌকিক ক্রিয়া কর্মের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে রেখেছিলেন ৷ তবে মার পূর্বেই তিনি গত হন ৷

পরবর্তীকালে রেবতীমণি দেবী-র মৃত্যুর পর রামচাঁদ শীলের ছেলেরা পিতামহীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য সেই টাকা তাঁদের কাকা অর্থাৎ রামচাঁদের দুই ছোট ভাই দ্বারকানাথ শীল ও নন্দলাল শীলের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ৷ কিন্তু কাকারা সেই অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন ৷ এবং নিজেরাই মায়ের শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন ৷ শুধু তাই নয়, দ্বারকানাথ ও নন্দলাল ওই টাকা দানধ্যানের জন্য ব্যবহার করতে উপদেশ দেন। তখন রামবাবুর ছেলেরা ওই টাকা ঋণপত্রে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ৷ তার অর্চিত সুদ থেকে শুরু হয় খয়রাতি প্রদান ৷ দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের নাম নথিভুক্ত করা হয় ৷ যাঁদের নাম নথিভুক্ত থাকত, তাঁদের একটি করে পেতলের টিকিট দেওয়া হত ৷ সেই টিকিটটি দেখিয়ে টাকা পাওয়া যেত ৷ বহুদিন পর্যন্ত এই প্রথা টিকে ছিল। 





পুজো শুরু কবে থেকে- 
১৮৫৫ সালে প্রথম দোল উৎসব পালিত হয় শীল বাড়িতে। তার ঠিক এক বছর পর ১৮৫৬ সালে শুরু হয় দুর্গাপুজো। বাড়ির প্রাণপুরুষ রামচাঁদ ও তাঁর সহধর্মিনী ক্ষেত্রমণিদেবী এই পুজোর সূচনা করেন। 

রামমোহনের যুগে মূর্তিপুজো
রামবাবু যখন কলকাতায় পুজোর সূচনা করছেন তখন বাংলায় রামমোহনের যুগ ৷ নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা আর পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রচার করে যিনি সারা দেশে তখন নতুন যুগের ঢেউ আনছেন ৷ বাংলায় নবজাগরণ আনলেন তিনি ৷ ১৮২৭-এ তৈরি হয়েছে ব্রাহ্ম সমাজ ৷ তার মধ্যেই নতুন করে পুজোর আয়োজন করলেন রামচাঁদ ৷ কুলগুরুর পরামর্শে ও ঈশোপনিষদের মতাদর্শকে সামনে রেখে দেবী দুর্গার আকারে শুরু হল প্রকৃতির আরাধনা। 


পুজো পদ্ধতি- 
রথের দিন হয় কাঠামো পুজো ৷ রাধাষ্টমীর দিন পুজোর সমস্ত মাঙ্গলিক জিনিসপত্র কেনা শুরু হয় ৷ এরপর মহালয়া থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ ৷ পিতৃপুরুষের তর্পণ করে ঘটে শুরু হয় অধিবাস ৷ এরপর ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু হয় পুজো।  সপ্তমীতে অগ্নিহোত্রী যজ্ঞের সূচনা আর নবপত্রিকার মহাস্নান হয় সন্ধিপুজোয় বলির বদলে ধ্যান করেন পরিবারের সদস্যরা।প্রকৃতি জ্ঞানে দেবীর পুজো হয় বলেই এখানে গাভী পুজোর চল রয়েছে অষ্টমীর দিন। অষ্টমীর দুপুরের গাভী পুজো এই বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নবমীতে নারী ও জননীকে পুজো করা হয় এই শীলবাড়িতে। নবমীতে কুমারী পুজোর পাশাপাশি সধবা পুজোও সেভাবে আর অন্য কোথাও দেখা যায় না। 

ভোগবৃত্তান্ত- 
বৈষ্ণব মতে পুজো হয় এখানে। ভোগে থাকে লুচি, ফল, মিষ্টি।ষষ্ঠী থেকে নবমী নিরামিষ। বিশেষত্ব হিসেবে শুক্তোয় পাটপাতা দেওয়া হয়, থাকে পানিফল ও পাঁপড়ের ডালনা। বাড়ির দালানে প্রতি বেলা ১৫০-২০০ জনের পাত পড়ে। 

বিসর্জন- 
আগে কাঁধে চেপে দেবীকে নিয়ে যাওয়া হত বিসর্জনের পথে। এখন অবশ্য প্রতিমাকে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। 

আরও পড়ুন-
বন্ধ দরজার ওপারে এখনও বাস করেন জমিদার গিন্নি? দুর্গাপুজোয় আলোয় ঝলমল করে ওঠে বারুইপুরের গা ছমছমে জমিদারবাড়ি  
রাসমণির বাড়ি হয়ে বিশ্বাস পরিবার, রানির মেয়েদের পরম্পরায় দুর্গাপুজোর নাম এখন ‘তিন বাড়ি’-র পুজো
শাড়ি পরে দুর্গাপুজো করেছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রানি রাসমণির বাড়ির পুজোতে এসেছিলেন রবি ঠাকুরও

Read more Articles on
Share this article
click me!