বিদ্যাসাগরের বহু আগে বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন মতিলাল শীল, তাঁর দুর্গাপুজোর জমকে তাক লেগেছিল সমস্ত কলকাতাবাসীর

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু আগে যিনি বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন। যার জায়গাতেই গড়ে ওঠে কলকাতা মেডিকেল কলেজ। সেই মতিলাল শীলের বাড়ির পুজো। 

মেডিক্যাল কলেজের কাছে কলুটোলা অঞ্চলে এক বিরাট দুর্গোৎসবের সূচনা করেন মতিলাল শীল। যা দেখে কলকাতাবাসী চমকে গেছিল। লিখেছেন, সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার

কে এই মতিলাল শীল? 
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু আগে যিনি বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন। তাঁর জায়গাতেই গড়ে ওঠে কলকাতা মেডিকেল কলেজ। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উন্নতিকল্পে মতিলাল শীল ১২ হাজার টাকা দান করেন। তাঁর নামে হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের নাম হয় মতিলাল শীল ওয়ার্ড। ১৮১৫ নাগাদ তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে কাজে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করার বরাত পান। এরপর নিজ ক্ষমতা আর বুদ্ধিবলে আস্তে আস্তে উন্নতি করতে থাকেন। নীল, চিনি, কাপড়, চাল এই সব চেনার এবং পরখ করার ক্ষমতার জন্য তৎকালীন বেশ কিছু এজেন্সি তাঁকে ‘বেনিয়ান’ হিসাবে নিয়োগ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে এমন কোনও ব্যবসা সেই সময় খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল যাতে মতিলাল শীল বিনিয়োগ করেননি। বনেদি জমিদার বলতে যা বোঝায় মতিলাল ছিলেন তাই। মতিলালের সমাজ সংস্কারের কথা বলে শেষ করা যাবে না। মতিলাল শীল ফ্রি স্কুল,কলেজ থেকে আরও কতও কী!

Latest Videos


কবে থেকে পুজো শুরু- 
অনুমান দুশো বছর আগে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল। সেই সময় শোভাবাজার রাজবাড়িতে ধূমধাম করে পুজো হয়। কিন্তু সেই পুজোয় শুধুমাত্র সাহেব সুবো আর সমাজের উচ্চবর্গীয় মানুষের প্রাধান্য। সাধারণ মানুষের বিশেষ জায়গা নেই সেখানে। মতিলাল শীল তাঁর এক প্রজার মুখে এই ঘটনার কথা শুনে ঠিক করলেন তিনি নিজে দুর্গাপুজো শুরু করবেন আর এমনভাবে পুজো করবেন যাতে সব মানুষ সেই পুজোয় অংশ নিতে পারেন। মেডিক্যাল কলেজের কাছে কলুটোলা অঞ্চলে তার নিজের বাড়িতে কিছুদিনের মধ্যেই পুজো শুরু করলেন তিনি। সত্যি সত্যিই সে এক দেখার মতো পুজো হল। 





পুজো পদ্ধতি- 
মতিলাল শীল বাড়ির দেবীমূর্তি একচালার, সিংহের রঙ সাদা। উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে পুজো শুরু হয়। পাঁচজন ব্রাহ্মণ আসেন এদিন। একজন চণ্ডীপাঠ করেন। ষষ্ঠী থেকে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। সপ্তমীর দিন সকালে মতিলাল শীল ঘাটে কলাবৌ স্নানের পর বাড়ির কুলদেবতা লক্ষ্মী নারায়ণ মূর্তিকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। পুজো চলাকালীন তিনি নীচেই থাকেন। ঠাকুরের শয়ন হয় না। অষ্টমীর দিন সকালে বাড়ির মেয়েরা ঠাকুরের সামনে ধুনো পোড়ান। সন্ধিপুজোয় ঠাকুরের সামনে দেওয়া হয় একমন চালের নৈবেদ্য। কোনও পাত্রে নয়, মাটিতে কলাপাতা পেতে তার ওপর নৈবেদ্য দিয়ে চারিদিকে মালসা সাজিয়ে দেওয়া হয়। বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। এই বাড়িতে বলি হয় না। তবে আখ, ছাঁচিকুমড়ো, বাতাবি লেবু বলির জন্য সাজিয়ে পুজোর সময়ে ঠাকুরদালানে দিয়ে দেওয়া হয়। একসময় নবমীর দিন দেখার মতো ব্রাহ্মণ বিদায় হত এই বাড়িতে। সেই দিন দেড়শো দু’শো জন ব্রাহ্মণকে নানা দানসামগ্রী, সুপুরি আর টাকা দিয়ে ব্রাহ্মণ বিদায় করা হত। এখন যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দশ-বারো জনে।


সিঁদুর খেলা-
এই বাড়িতে সিঁদুর খেলায় ঘটা হয় না। ঠাকুরের পায়ে সিঁদুর ছুইয়ে সেই সিঁদুর মাথায় দেন এয়োরা। তবে ঠাকুর বরণ দুই বার হয় এই বাড়িতে। প্রথম দফায় যাঁদের এই বছর পালা ছিল তাঁরা এবং অন্যান্যরা ঠাকুর বরণ করেন। দ্বিতীয় দফায় আগামী বছর যাঁদের পালা থাকবে তাঁরা পান, সুপারি দিয়ে ঠাকুরকে আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখেন। 


বিসর্জন- 
মতিশীল নির্মিত ঘাটেই হয় ঠাকুর বিসর্জন। 
আগে ৪০ জন বাহক কাঁধে করে ঠাকুর নিয়ে গঙ্গায় যেতেন বিসর্জনের জন্য। ’৪৬-এর দাঙ্গা সেই নিয়ম পাল্টে দিয়েছে। দাঙ্গার বছর বাড়ির মূল দরজা বন্ধ রেখে বাইরে সশস্ত্র পুলিশ বসিয়ে পুজো সম্পন্ন করা হয়েছিল বটে কিন্তু ঠাকুর আর কাঁধে করে পাঠানো যায়নি গঙ্গায়। জোড়া নৌকোও এখন আর আসে না বিসর্জনের জন্য।

ভোগবৃত্তান্ত-
 শীল বাড়িতে অন্নভোগ হয় না, লুচি ভোগ হয়। পঞ্চমীর দিন থেকে ভিয়েন বসিয়ে দরবেশ, লেডিকেনি, মালপোয়া, গজা, নারকেল নাড়ু আর নোনতার মধ্যে কচুরি, সিঙ্গারা, নিমকি দেওয়া হয়। পুজোর প্রতিদিন ২৮ কিলো করে নৈবেদ্য ভোগ হয়। ২৮টি পাত্রে একমন করে চাল কলা মিষ্টি-সহ নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হয়।


পুজোর বিশেষ আকর্ষণ- 
আগে এই বাড়িতে ষষ্ঠীর দিন কীর্তন হত। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিনদিন যাত্রা হত। নিমাই সন্ন্যাস খুবই জনপ্রিয় যাত্রাপালা ছিল সেই সময়। প্রায় প্রত্যেক পুজোতেই নিমাই সন্ন্যাস হত। এছাড়াও ঠাকুরদালানের উল্টোদিকে দোতলায় ছিল বিরাট নাচঘর। পুজোর সময় বাইনাচও হত নিয়মিত। রাইচাঁদ বড়াল ছিলেন এই পরিবারের বিশেষ বন্ধু। সেই সময়ের বহু নামী গায়িকা, নর্তকী তাঁর চেনাজানার সুবাদে এই বাড়িতে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন।এখন অবশ্য নাচঘরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

আরও পড়ুন-
পেতলের টিকিট দেখিয়ে চোরবাগানের শীল বাড়ি থেকে টাকা পেতেন গরীব-দুখীরা, জেনে নিন সেই বাড়ির দুর্গাকথা
বন্ধ দরজার ওপারে এখনও বাস করেন জমিদার গিন্নি? দুর্গাপুজোয় আলোয় ঝলমল করে ওঠে বারুইপুরের গা ছমছমে জমিদারবাড়ি  
এক লাঠির ঘায়ে কুপোকাত হয়েছিল ৬ ডাকাত, ঐতিহ্যবাহী টাকি রাজবাড়ির দুর্গাপুজো বৈষ্ণব থেকে মিলে গিয়েছিল শাক্ত ধারায়

Read more Articles on
Share this article
click me!

Latest Videos

'একত্রিত হতে হবেই, ওরা ৫০ পেরলেই শরিয়া আইন চালু করবে' গর্জে উঠলেন শুভেন্দু | Suvendu Adhikari | News
'Mamata Banerjee-র জন্যই অভয়ার এই অবস্থা' বলতে গিয়ে এ কী বললেন Suvendu Adhikari, দেখুন
শুভেন্দুর বিরাট ঘোষণা! সোনাচূড়ার আড়াই বিঘা জমিতে হবে বিশাল Ram Mandir | Suvendu Adhikari
'সনাতনী সম্মেলন'-এ Suvendu Adhikari-র বিশেষ বার্তা, দেখুন সরাসরি
‘RG Kar-র তথ্য প্রমাণ Mamata Banerjee-র নির্দেশে লোপাট হয়েছে’ বিস্ফোরক Adhir Ranjan Chowdhury