সংক্ষিপ্ত
‘টাকির লাঠি, সাতক্ষীরার মাটি আর গোবরডাঙ্গার হাতি সুপ্রসিদ্ধ’, টাকিকে ঘিরে কেন জন্ম নিয়েছিল এই প্রবাদ, জানেন কি?
টাকির জমিদারির ইতিহাস প্রায় চারশো বছরের। মোগল যুগে যশোররাজ প্রতাপাদিত্যর শাসনকালে ভূস্বামী ভবানীদাস রায়চৌধুরীর নাম পাওয়া যায়। তিনিই টাকির জমিদার বংশের আদি পুরুষ। তারপর বহু উথ্থান পতনের মধ্যে দিয়ে ভবানীদাসের পুত্র-প্রপৌত্রগণ জমিদারি পরিচালনা করেছেন, মূলত চার শরিকে বিভক্ত হয়ে। তার মধ্যে উল্লেখ্য মুন্সিবাড়ি, পুবের বাড়ি, উত্তরের বাড়ি এবং পশ্চিম বাড়ি। ঐতিহাসিক টাকি রাজবাড়ির পুজো নিয়ে লিখেছেন, সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার।
রামমোহন দ্বারকানাথ স্মৃতি -
টাকির জমিদারগণ ছিলেন মূলত বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। পরে তাঁদের সঙ্গে শাক্ত ভাবধারা যুক্ত হয়। তাঁদের পারিবারিক দেবতা ছিলেন গোবিন্দদেব, এবং রাধামাধব। মুন্সিবাড়ির বিখ্যাত জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী রাজা রামমোহন রায়ের ঘনিষ্ট, এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের অন্তরঙ্গ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ব্রাহ্ম ভাবধারা থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন, কিন্তু শাক্ত ভাবধারায় প্রবিষ্ট হয়েছিলেন এক সময়। তিনি ছিলেন একজন উদার, সাংস্কৃতিক চেতনা সম্পন্ন জমিদার। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক উন্নয়নে তাঁর যেমন সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তেমনই আখড়াই, হাফ আখড়াই, আগমনী গান রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
পুবের বাড়ির পুজো-
টাকিতে জমিদার বাড়ির মধ্যে প্রথম পুবের বাড়িতে দূর্গাপুজো শুরু হয়। হরিনারায়ণ ঘােষ ছিলেন এর উদ্যোক্তা। জমিদারি যশাের জেলায় তেই বেশিরভাগ ছিল। ঘােষ বংশধর প্রয়াত শচীন্দ্রনাথ ঘােষ, হিরণ চন্দ্র ঘােষ ও প্রতীক চন্দ্র ঘােষ , প্রসূন ঘােষ মহাশয়রা এক বছর অন্তর পালা করে শাক্ত মতে পাঠা বলি দিয়ে পুজো করতেন। পরবর্তীতে ঘােষ বংশধর প্রয়াত মতিলাল ঘােষ মহাশয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করায় বৈষ্ণব মতে আখ ও চাল কুমড়াে বলি আজ ও প্রচলিত। মতিলাল বাবু বিখ্যাত ছিলেন টাকির লাঠি খেলায় আর অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। তিনি একাই ডাকাতদের সাথে যুদ্ধ করে ছয় সাত জন ডাকাত কে বেঁধে টাকিতে নিয়ে এসেছিলেন। সেখান থেকে একটি প্রবাদ শােনা যেতাে , টাকির লাঠি, সাতক্ষীরার মাটি আর গোবরডাঙ্গা হাতি সুপ্রসিদ্ধ।এই ঘােষবাবু বাড়িতে পৌরসভার একটি অস্থায়ী কার্যালয় ছিল যেখানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর পদার্পন ঘটেছিল।
অতীতে বসত কবিগানের আসর-
টাকির দুর্গাপুজোয় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ-গানের আসর বসত। পুতুল নাচ ছিল এইসব আসরের অন্যতম আকর্ষণের দিক। জমিদার বাড়ি থেকেই এসব ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হত। একবার বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার পুত্র মাধব ময়রা টাকি বাজারে কবিগান গেয়ে আসর মাত করে দিয়েছিলেন।
মূর্তি নির্মানে অভিনবত্ব-
টাকির সবচেয়ে বড়ো পুজো হত পুবের বাড়ি ও দক্ষিণ বাড়িতে। এখানকার মূর্তি ঢাকেশ্বরী রীতিতে নির্মাণ করার প্রথা ছিল। এজন্য কৃষ্ণনগর থেকে পাল বংশের বিখ্যাত মৃৎ কারিগরদের টাকিতে এনে জমি দিয়ে বসতি স্থাপন করিয়ে দেন। তাঁরা আজ এখানকারই বাসিন্দা হয়ে গেছেন।
পুজো ঐতিহ্য-
টাকির জমিদার বাড়ির পুজোর বিশেষ দিক হল, নবমীর দিন মহিষ বলি দেওয়ার প্রথা। এজন্য চারদিক থেকে প্রচুর জনসমাগম হত। তবে সময়ের ক্ষয়িষ্ণুতায় এই প্রথা বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে আজও মানুষজন টাকির জমিদার বাড়ির পুজো বললে মহিষ বলির কথা বলবেই। এখন সেই দিন নেই, সেই জমিদারও নেই। তবে টাকি আছে টাকিতেই। দুর্গোৎসবের জাঁকজমকের দায়িত্ব এখন বিভিন্ন ক্লাবগুলির। তারাই টাকির দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
বিজয়ার দুর্গা ভাসান-
টাকি রাজবাড়ির একটি জনপ্রিয় রেওয়াজ ছিল বিজয়ার দিন দুর্গা ভাসান। ইছামতী নদীর অপর পারে বাংলাদেশ। ভাসানকে কেন্দ্র করে দুই বাংলার মানুষ আজও এক হন। এ এক হওয়ার অত্যাশ্চর্য মিলনক্ষেত্র। আর এই দৃশ্য দেখার জন্য বহু মানুষ আজও ভিড় করেন টাকিতে। টাকির দুর্গোৎসবের একটা বড় ঐতিহ্য এখন এই বিসর্জন।
আরও পড়ুন-
১৭৫৭ সালের কাঠামোতেই এখনও গড়ে ওঠে শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফের দুর্গা প্রতিমা, জেনে নিন সেই পুজোর ইতিহাস
বাঈজি নাচ থেকে বলড্যান্স, নবাব সিরাজের অর্থ পেয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় এসেছিল ইংরেজরেজদের বৈভবের ছাপ