সৌমিত্রর অভাব পূরণীয়? ভাবীকাল মনে রাখবে তাঁকে? জানালেন কমলেশ্বর, ঋতব্রত, দীপ্সিতা, শ্রীকান্ত

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নেই। তাঁর অভাব কি পূরণ হল? আগামি প্রজন্ম আদৌ ভাবে তাঁকে নিয়ে? জানার কৌতূহল অভিনেতার মেয়ে পৌলমী বসু, ছেলে সৌগত চট্টোপাধ্যায়ের।

Mukherjee Upali | Published : Nov 15, 2022 9:28 AM IST

২০২০-র ১৫ নভেম্বর আর ২০২২-এর ১৫ নভেম্বরের মধ্যে কত ফারাক! দু’বছর আগে তিনি অন্তিম শয়ানে। দুবছর পরে তিনি আকাদেমির রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে! মুখে মৃদু হাসি। লাল টুকটুকে জামায় প্রচণ্ড পুরুষালি। বাঙালি তাঁকে যে ভাবে দেখে অভ্যস্ত। দেখতে দেখতে দু’বছর পার। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নেই। তাঁর অভাব কি পূরণ হল? আগামি প্রজন্ম আদৌ ভাবে তাঁকে নিয়ে? জানার কৌতূহল অভিনেতার মেয়ে পৌলমী বসু, ছেলে সৌগত চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁদের এই আগ্রহকে প্রশ্রয় দিয়েই সৌমিত্র ও দীপা চট্টোপাধ্যায় ফাউন্ডেশন এবং শ্যামবাজার মুখোমুখি নাট্যদলের আয়োজন, প্রথম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা। ২০২২-এর ১৪ নভেম্বর জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে সৌমিত্রবাবুর স্মৃতিতেই তাঁকে স্মরণ পরিচালক-অভিনেতা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, কণ্ঠশিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য, কবি যশোধরা রায়চৌধুরী, এই প্রজন্মের অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় এবং বামনেত্রী দীপ্সিতা ধরের। গোটা অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় শ্রমণা ঘোষ।

প্রত্যেক শুরুর-ই একটা শুরু থাকে। এই বিশেষ অনুষ্ঠানের নান্দীমুখের দায়িত্বে পূর্ব-পশ্চিম দলের কর্ণধার সৌমিত্র মিত্র। তিনি আজীবন মাটির কাছাকাছি থেকে যাওয়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি এও স্বীকার করে নিয়েছেন, যাঁর কবিতা, কাব্যপাঠ, অভিনয়, নাটক পরিচালনা, রাজনীতিমনস্কতা— কোনওটাই কারওর থেকে কমতি নয়। ফলে, সামান্য সময়ে তাঁকে বর্ণনা করার চেষ্টা অপরিণতমনস্কতার সমান। পরিচালক-অভিনেতার দাবি, কোনও কাজই ‘আমি করছি’ মনোভাব নিয়ে করেননি তিনি। ‘এটা আমার পেশা, আমি সেটাই করছি’— এই ভাবনা তিনি আজীবন নিজের মধ্যে লালন করে গিয়েছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা দেন আরও এক মঞ্চ, ছোট এবং বড় পর্দার দাপুটে অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। তিনি এ দিন সংযোগের কথা বলেন। যে সংযোগ সংলাপ দিয়ে দর্শক এবং নাটকের মধ্যে গড়ে দেন অভিনেতা। নাট্যজীবনে তাঁর দেখা একাধিক ঘটনার উদাহরণ সামনে রেখে দেবশঙ্কর তাঁর ভাবনাকে জীবন্ত করেন শ্রোতাদের সামনে।

তৃতীয় এবং শেষ ভাগ ছিল কালজয়ী অভিনেতাকে নিয়ে আলোচনা। তার তিনটি পর্ব। প্রথমটিতে তাঁর কোনও সত্তা বাঁচিয়ে রাখার মতো। দ্বিতীয় পর্বে, তাঁর কোন ছবির কোন চরিত্রে নিজেকে দেখতে চান আলোচনায় অংশ নেওয়া তারকারা। আলোচনার শুরুতেই শ্রীকান্ত আচার্যর মত, ‘তাঁর সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যে টুকু সাক্ষাৎ তার বড় অংশজুড়ে থাকত গান এবং কবিতা। এক বার রবীন্দ্রনাথের গান এবং তাঁর নেপথ্য কাহিনী একসঙ্গে গেঁথে দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। যার গানে শ্রীকান্ত পাঠে সৌমিত্রবাবু। এক দিন গায়কের ইচ্ছে, তিনি সৌমিত্রবাবু কী ভাবে পড়ছেন সেটা নিজের কানে শুনবেন। সেই ইচ্ছে নিয়ে তিনি স্টুডিয়োয় যান। গিয়ে দেখেন চিত্রনাট্য নিয়ে বসে কিংবদন্তী অভিনেতা। একটি অংশ চমৎকার পড়ছেন যথারীতি। তার পরেও তিনি সেই অংশ বাতিল করে আবার পড়লেন। অভিনেতার যুক্তি, তাঁর কণ্ঠে আবেদের ঘাটতি ছিল। শ্রীকান্তকে আজও সৌমিত্রবাবুর সেই খুঁতখুঁতামি তাড়া করে ফেরে।’

 

 

সৌমিত্রবাবুকে কী ভাবে বিশ্লেষণ করলেন কমলেশ্বর? তাঁর মতে, অভিনেতার পাঁচটি সত্তা এক যোগে তাঁকে আকর্ষণ করে। অনেকটা ব্ল্যাঙ্ক ভার্সের মতো। তাঁরা অভিনয়, পরিচালনা, কবিতা, আবৃত্তি আর কর্মী-রাজনৈতিক সৌমিত্র। অর্থাৎ, কমলেশ্বরের চোখে সৌমিত্রবাবু স্বয়ংসম্পূর্ণ। যশোধরার কাছে সব ছাপিয়ে উঠে এসেছে সৌমিত্রবাবুর কবিতা। আটের দশকে, যখন অভিনেতার কাব্যগ্রন্থ রীতিমতো চর্চায়, তিনি সেই বইয়ের পাতা উল্টে পড়তে ভালবাসতেন। দীপ্সিতা তুলে ধরেন তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে। তাঁর আফসোস, এই মুহূর্তে ছমাস পরে কে কোন রাজনৈতিক দলে থাকবে সেটা বোঝা দায়। অথচ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজীবন একটি দলকেই সমর্থন করে গেলেন। ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ স্লোগান জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। একই ভাবে জীবনের ভালয়-মন্দয় দীপ্সিতা আউড়ে গিয়েছেন ‘ফাইট কোনি ফাইট’ সংলাপ।

ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় এই প্রজন্মের অভিনেতাদের অন্যতম। নাটক, পর্দায় অনায়াস তিনি। এ দিন তাঁর আক্ষেপ, আজকের দিনে সব আছে। কেবল পড়াশোনা ছাড়া। সৌমিত্রবাবুকে তিনি বরাবর পড়াশোনায় ডুবে থাকতে দেখেছেন। আজকের প্রথম সারির নায়কেরা শরীরের যত্ন নিয়ে ডিমের সাদা অংশ খান। শরীরচর্চা করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিত্য আনাগোনা তাঁদের। কেবল পড়াশোনা নিয়ে একটা কথাও খরচ করেন না! অনুষ্ঠানের শেষে ছোট্ট বক্তব্য রাখেন বিভাস চক্রবর্তী। তাঁর মতে, তাঁর সঙ্গে সৌমিত্রবাবুর সম্পর্ক দুচার কথায় বলা সম্ভব নয়। তবে আদ্যপান্ত তিনি ছিলেন মাটির কাছাকাছি। তুলনা টেনে বলেন, উত্তমকুমার দর্শকদের থেকে দূরত্ব রাখায় বিশ্বাসী ছিলেন। সেখানে সৌমিত্রবাবু অনায়াসে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনে কাপড় মেলেছেন। বাড়ির বাজারও করেছেন! আবার যখন মঞ্চে তখন তিনিই রাজা। এই ভারসাম্য তিনি খুব কম তারকা অভিনেতার মধ্যে দেখতে পেয়েছেন।

সৌমিত্র-স্মরণ পর্যায়ে আরও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়েছে। শুরু ১২ নভেম্বর থেকে। উদ্বোধনে শিল্পী যোগেন চৌধুরী, অভিনেতা-নাট্য পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। সৌমিত্রবাবুর ব্যবহার করা জিনিস এবং ছবি, হাতে আঁকা ছবি দিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের পশ্চিম গ্যালারিতে। চলবে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত। ১৩ নভেম্বর গিরিশ মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘অন্ধযুগ’।

 

Share this article
click me!