১৫ নভেম্বর,আপামর বাঙালির বড্ড বিষাদের দিন। কারণ এই বিশেষ দিনেই এমন এক ব্যক্তিত্ব হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো, যার মৃত্যুতে বাঙালি সহ গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
আবারও এল সেই বিষাদের দিন। এই দিনটি আসলেই বাঙালির মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। ১৫ নভেম্বর,আপামর বাঙালির বড্ড বিষাদের দিন। কারণ এই বিশেষ দিনেই এমন এক ব্যক্তিত্ব হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো, যার মৃত্যুতে বাঙালি সহ গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। বিনোদন জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাঙালির মন আজ ভারাক্রান্ত। দেখতে দেখতে বছর ঘুরলেও প্রিয় নায়ক-অভিনেতা-কবি-নাট্যকারের সেই উজ্জ্বল উপস্থিতি সকলের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে রয়েছে। ৬০ বছরেরও বেশি অভিনয় জীবনে ৩০০-র বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয়। এহেন অভিনেতার চলে যাওয়াটা যেন আজও মেনে নিতে পারছে না বিনোদন তথা বাঙালিরা। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যেন জুড়ে রয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । এছাড়াও তখনকার সময়ের বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেন থেকে তপন সিংহ, আবার হালফিলের শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটির সঙ্গে কাজ করে একের পর এক স্মরণীয় চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন।
বাঙালির ফেলুদা বললেই সবার আগে সৌমিত্রর নাম মাথায় আসে। স্ক্রিনে হোক কিংবা বইয়ের পাতায় সত্যজিতের ফেলুদা গল্পে প্রথম থেকেই একজন আইকনিক হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফেলুদা ভক্তরা সকলেই একথা জানেন। কারণ সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়ও নিজেই জানিয়েছেন, কীভাবে তার বাবা সৌমিত্রকে বসিয়ে স্কেচ করতেন। সত্যজিৎ রায়ের এই গোয়ান্দাকে গিয়ে বাঙালির যথেষ্ঠ আবেগ রয়েছে। কারণ একটাই সত্যজিতের ছবিতে তিনিই প্রথম ফেলুদা। চুরুটের টান থেকে চাঁদরের আইকনিক স্টাইল বাঙালির যুবকের কাছে আইডল ফেলুদা। আজও ফেলুদা বলতে একজনের কথা সবার আগে মনে পরে তিনি হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফেলুদার কথা উঠলেই একের পর এক প্রসঙ্গ উঠে আসে। গোয়েন্দাকাহিনির হিরো প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদার চরিত্রে যে তাকে নেওয়া হতে পারে তা কখনওই ভাবেননি সৌমিত্র। সত্যজিৎ রায় পরিচালিক ফেলুদার প্রথম উপন্যাস সোনার কেল্লার চলচ্চিত্রায়ণের সময় অভিনেতাকে ডেকে পাঠান পরিচালক। নাম ভূমিকায় অভিনয় করার কথা জেনেই রীতিমতো উত্তেজিত হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । পরবর্তীকালেও বিভিন্ন পত্রিকায়, বই-এ প্রকাশিত ফেলুদার গল্পে প্রধান চরিত্রে তার অবয়ব ফুটিয়ে তোলেন সত্যজিৎ রায়। আর এভাবেই 'জয় বাবা ফেলুনাথ' ছবি তৈরির আগেই গোয়েন্দা ফেলুদা দর্শকদের মনে নিজের জায়গা তৈরী করে নেন। তবে শুধু ফেলুদাই নয়, নায়ক থেকে খলনায়ক সমস্ত ধরনের চরিত্রেই অভিনয়ে দর্শকমনে ছাপ ফেলেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।
সালটা ১৯৬১। 'ঝিন্দের বন্দী'-ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখে রীতিমতো হতবাক হয়েছিলেন। এই ছবিতেই প্রথম খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করে সকলকে চমকে দিয়েছেনন সৌমিত্র । নায়ক অপু হিসেবে যিনি এতদিন সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তাকেই কিনা তপন সিংহ বানিয়ে দিলেন 'খলনায়ক'। ১৯৬৫ সালে 'আকাশ কুসুম' ছবিতেও তরুণ অজয়ের রাতারাতি ধনী হওয়ার গল্প মন কেড়েছিল দর্শকদের। এই ছবির পর সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের মধ্যে তিক্ত পত্রযুদ্ধ বেঁধেছিল।সালটা ১৯৭০। নিত্যানন্দ দত্তর 'বাক্স বদল' ছবিতে মানসিক রোগের চিকিৎসক প্রতুল ভট্টাচার্যর চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । সালটা ১৯৬৯। আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'তিন ভুবনের পারে' ছবির নায়ক যেন ভবঘুরে এক রোমিও । সৌমিত্রর অভিনয় আজও ভুলতে পারেনি দর্শক। ১৯৭৩ সালে 'বসন্ত বিলাপ' ছবিতে হোস্টেলের নেতা শ্যামসুন্দরের চরিত্রে অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতিভাবান পরিচালক সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করলেও ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজ করা শেষ অবধি হয়ে ওঠেনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের । ১৯৭৫ সালে তরুণ মজুমদার করলেন। ১৯৮৩ সালে পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি 'অগ্রদানী' ছবিতে ব্রাহ্মণ পূর্ণ্য চক্রবর্তীর চরিত্রে সৌমিত্রর অভিনয় আজও ভোলার নয়। সালটা ১৯৮৪। 'সরোজ গের কোনি'-তে সাঁতারু মেয়ের কোচের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের মন জিতে নিয়েছিলেন সৌমিত্র । ১৯৮৬ সালে 'আতঙ্ক' ছবিতে মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে খুনির পরিচয় জেনেও তা প্রকাশ করতে না পারার সেই যে অসহয়তা তা দক্ষ ভাবে ফুটিয়ে তোলেন সৌমিত্র। পরিচালক তপন সিংহের কালজয়ী ছবি 'হুইলচেয়ার' (১৯৯৪) ছবিতে প্রতিবন্ধী ড.মিত্রর চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে বেশ কয়েকমাস হুইলচেয়ারেই চলাফেরা করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৮৮ সালে বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আদলে তৈরি গুরুদাস ভট্টাচার্যের চরিত্রে তরুণ থেকে বৃদ্ধ বয়সকে যেন জীবন্ত রূপ দিয়েছিলেন বাঙালির আইকন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-
সত্যজিতের বিমলাকে ছাঁপিয়ে গেলেন আরতি, 'বেলাশুরু'-তে নবরূপে ইতিহাস গড়লেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়