নায়ককে ছাড়া এতটা পথ একা একা পাড়ি দিতে পারবেন তো নায়িকা? নাকি তাঁর হাত ধরতে আসবেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা! ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরছে, এই আনন্দেই কি তাঁর এত বড় আকাশ আলোয় আলো?
১৬ দিনের লড়াই শেষ। জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন মাত্র ২২-এর ঐন্দ্রিলা শর্মা। ক্যান্সার, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগের পরপর ত্রিফলা আক্রমণ। লড়তে লড়তে ক্লান্ত তিনি। যদিও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে গিয়েছেন। মাটি কামড়ে পড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টাও ছিল। কিন্তু সবই বৃথা। সব্যসাচীর সব বিশ্বাস, ভালবাসা উপেক্ষা করে অভিনেত্রী চির ঘুমের দেশে। পশ্চিমবাংলা কাঁদছে স্বল্পায়ু, প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর জন্য। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পরেই ঐন্দ্রিলা অতল ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবার থেকে পরিজন, আত্মীয় থেকে অনাত্মীয়— সবাই তাঁর জন্য কী ভাবে হা-পিত্যেশ অপেক্ষা করছেন? ছোট পর্দার নায়িকা দেখতেও পাননি! কেবল সব্যসাচী ডাকলে তাঁর অচেতন শরীরেও প্রাণের সাড়া জাগত। ওই অবস্থাতেই তিনি তাঁর হাত ধরার চেষ্টা করতেন। শরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ছুটত। হৃদস্পন্দন বেড়ে ১৩০-১৪০ হয়ে যেত। উত্তেজনা দেখা দিত ঐন্দ্রিলার প্রতিটি অঙ্গে। চিকিৎসার পরিভাষায়, একেই বলে ইন্টারনাল স্টিমুলি। সব্যসাচী তাই ফেসবুকে চরম আত্মবিশ্বাসী, ‘জেনে রাখুন মেয়েটা লড়ে যাচ্ছে, সাথে লড়ছে একটা গোটা হাসপাতাল। নিজের হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম, নিজের হাতে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। এর অন্যথা কিছু হবে না।’
সোমবার প্রথম প্রকাশ্যে ভেঙে পড়েন ছোট পর্দার ‘সাধক বামদেব’। ফেসবুকে সবার উদ্দেশে আকুল আর্তি, ‘কোনও দিন এটা এখানে লিখব ভাবিনি, আজ লিখলাম। ঐন্দ্রিলার জন্য মন থেকে প্রার্থনা করুন। একমাত্র আপনাদের প্রার্থনা আর অলৌকিক ঘটনা ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে।’ সব্যসাচীর সঙ্গে সে দিনই ভেঙে পড়েছেন অভিনেতা যুগলের অসংখ্য অনুরাগী। সব্যসাচীকে ভরসা দিতে তাঁর সামাজিক পাতার মন্তব্য বিভাগে বানভাসি। ঐন্দ্রিলার সুস্থতা চেয়ে লাখো শুভেচ্ছা বার্তা সেখানে। প্রার্থনায় অংশ নিয়েছেন টলিউডের তারকারাও। মুম্বই থেকে ঐন্দ্রিলার জন্য প্রার্থনা জানিয়েছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। তিনি কুর্নিশ জানিয়েছেন সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলার লড়াইকে। তিনি সব্যসাচীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ওঁদের পারস্পরিক টান ভালবাসা সম্পর্কে নতুন করে বিশ্বাস জাগিয়েছে। মঙ্গলবার বড় মেয়ে মেঘলার জন্মদিন ছিল। একই বয়সী আরও একটি মেয়ে সেই সময়ে হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে। বিদীপ্তা চক্রবর্তীর মন কেঁদে উঠেছিল। তিনি আন্তরিক ভাবে লিখেছিলেন, ‘আমারও প্রায় এই বয়সী একটা মেয়ে আছে। তার জন্মদিনে আজ মন প্রাণ দিয়ে আমার এটুকুই প্রার্থনা, এই কঠিন লড়াই জিতে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক মেয়েটা। ঐন্দ্রিলার মা-বাবা আর সব্যসাচীর পাশে থেকে শুধু প্রার্থনা করছি, ওদের এই কঠিন সময় কেটে যাক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’ কেউ বুঝতে পারেননি, তাঁদের মতোই ঈশ্বরেরও বড় প্রিয় ঐন্দ্রিলা। তাই বারেবারে তাঁর উপরে চরম আঘাত হেনে তাঁকে কাছে টানতে চেয়েছেন! ভাল সন্তানকে ছেড়ে দূরে থাকতে তাঁরও যে কষ্ট হয়!
কবে থেকে ঐন্দ্রিলা প্রত্যেকের ঘরের মেয়ে? তার লড়াকু জীবন শুরু হতেই। তার আগে যদিও ছোট পর্দায় তাঁর অভিনয় প্রতিভা প্রমাণিত। সমস্ত সহ-অভিনেতাদের দাবি, কখনও কেউ তাঁকে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখেননি। সব সময় হাসতেন, হাসাতেন সবাইকে। আর যত ক্ষণ পারতেন হই-হুল্লোড় করতেন। ঐন্দ্রিলা কি কোনও ভাবে জানতেন, তাঁর হাতে সময় বড্ড কম? তাই প্রতি মুহূর্ত থেকে জীবনরস নিংড়ে নিতেন। আর উপভোগ করতেন বেঁচে থাকার আনন্দ। যখনই মৃত্যুকে হারিয়ে জীবনের পথে ফিরেছেন, উদযাপন করেছেন তার। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গী সব্যসাচী। বরাবর নেপথ্যে থেকেছেন। আগলে রেখেছেন তাঁর ঐন্দ্রিলাকে। সারা বাংলা তাঁর মধ্যেই খুঁজে পেয়েছে কাঙ্খিত প্রেমিককে। ঈশ্বরেরও কি এত ভালবাসা সহ্য হয়নি?
শর্মা বাড়ির ছোট মেয়েটি বরাবরের ব্যতিক্রম। মা-বাবা-দিদি চিকিৎসক। ঐন্দ্রিলার ছোট থেকেই স্বপ্ন, নায়িকা হবেন। পরিবারের কেউ কখনও তাঁর ইচ্ছেয় বাধা দেননি। উল্টে, তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। ছোট থেকেই মাথায় ঝাঁকড়া, ঘন চুল। চুলের ভারে জেরবার একরত্তি ঐন্দ্রিলা বিরক্ত হয়ে এক বার কাঁচি চালিয়ে মাথার ভিতর থেকে কিছুটা চুল কেটে দিয়েছিলেন। এতে যদি মাথাটা হাল্কা হয়! এ রকমই দুষ্টুমি, খুনসুটিতে মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে। বয়স তখন মাত্র ১৮। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন বলে ঠিক। তখনই প্রথম ক্যান্সারের থাবা বোনম্যারোতে। পড়াশোনা সেখানেই থমকে। সেই শুরু লড়াইয়ের। সুস্থ হওয়ার পরে ধীরে ধীরে ঐন্দ্রিলা সরে আসেন অভিনয় দুনিয়ায়। ২০১৭-য় ‘ঝুমুর’ ধারাবাহিক দিয়ে যাত্রা শুরু। মাত্র পাঁচ বছরে তাঁর ঝুলিতে ‘জিয়ন কাঠি’, ‘জীবন জ্যোতি’, ‘মহাপীঠ তারাপীঠ’-এর মতো একাধিক জনপ্রিয় ধারাবাহিক। এ ছাড়াও, জি বাংলা অরিজিনালসের ভোলেবাবা ছবিতে ‘একেনবাবু’ অনির্বাণ চক্রবর্তীর মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। অভিনয় করেন ক্লিক ওয়েব প্ল্যাটফর্মের সিরিজ ‘ভাগাড়’-এ। এই সিরিজে সব্যসাচী মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি, পুজোর আগে প্রচুর ফটোশ্যুটও করেছেন তিনি। আর মেতে উঠেছিলেন সব্যসাচী-সৌরভ দাস-দিব্যর রেস্তরাঁ ‘হোঁদল’ নিয়েও।
২০২১-এ দ্বিতীয় বার ক্যান্সারে আক্রান্তে হয়েছিলেন ঐন্দ্রিলা। এ বার মারণরোগ থাবা বসিয়েছিল ফুসফুসে। এই প্রথম নায়িকা ভেঙে পড়েছিলেন। সেই সময় পরিবারের সঙ্গে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল টলিউড। ভরসা জুগিয়েছিলেন অসংখ্য অনুরাগী। ক্যান্সার অবশ্য ঐন্দ্রিলার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও হয়েছে। নায়িকার মা শিখা শর্মা ক্যান্সার-মুক্ত। তিনি স্তন ক্যানসারে ভুগেছেন। লড়াই এবং সঠিক চিকিৎসার পরে সম্পূর্ণ সুস্থ তিনি। প্রথম সারির এক বেসরকারি হাসপাতালের নার্স বিভাগের প্রধান। এ ছাড়া, তাঁর এক মাসিও সম্প্রতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। ঐন্দ্রিলাকে এই ঘটনাগুলো সাময়িক হয়তো দমিয়ে দিত। পর মুহূর্তে গাঝাড়া দিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়তেন নিজের কাজে।
সব্যসাচী তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘‘ভাল আছে’ বলতে আমার ভয় লাগে। কিন্তু ঐন্দ্রিলা আছে। প্রচন্ডভাবে আছে। আমার সামনে শুয়ে থেকেও হয়তো কয়েক সহস্র মাইল দূরে আছে। কিন্তু ঠিক ফিরে আসবে। ওর একা থাকতে বিরক্ত লাগে।’ অভিনেতার কথার সুর ধরেই প্রশ্ন, নায়ককে ছাড়া এতটা পথ একা একা পাড়ি দিতে পারবেন তো নায়িকা? তিনি যখনই যেখানে গিয়েছেন, সব্যসাচী তাঁর চলনদার! নাকি তাঁর হাত ধরতে আসবেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা! ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরছে, এই আনন্দেই কি তাঁর এত বড় আকাশ আলোয় আলো?