ট্রফি জয়ের নিরিখে বোঝা সম্ভব নয়, ভারতীয় ফুটবলে (Indian Football) সুভাষ ভৌমিকের (Subhas Bhowmick) গুরুত্ব। তাঁর ধাক্কাতেই আধুনিক হয়েছিল এই দেশের ফুটবল।
ভারতীয় ফুটবলে একজন ম্যাজিক মানুষ ছিলেন, অমল দত্ত (Amal Dutta)। নিজের খরচে প্রোজেক্টর, স্ক্রিন এবং বিদেশি ফুটবলের ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। সকলকে খেলা দেখাতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রতিভা কুড়িয়ে আনতেন। এরপর আরও এক কোচকে পেয়েছিল ভারত, যিনি দেশের ফুটবল জগৎকে কূপমণ্ডুক না হয়ে, বাইরে তাকাতে শিখিয়েছিলেন। তিনি সুভাষ ভৌমিক (Subhas Bhowmick)। তবে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কতটা গ্রহণ করতে পেরেছে ভারতীয় ফুটবল, তা তর্কের বিষয়।
খেলোয়াড় এবং কোচ - দুই ভূমিকাতেই দারুণ সফল, এমন লোকের সংখ্যা শুধু ভারতীয় ফুটবল কেন, গোটা বিশ্ব ফুটবলেই কম। সুভাষ ভৌমিক সেই হাতে গোনা ব্যক্তিদের একজন। ফুটবলার জীবনে যেমন ১১ বছর ধরে দাপিয়ে খেলেছেন ময়দানের দুই প্রধানে, বাংলার হয়ে কিংবা ভারতীয় জাতীয় দলের হয়ে, তেমনই কোচ হিসাবেও কলকাতার তিন প্রধান ক্লাবের পাশাপাশি গোয়ার সালগাঁওকর ও চার্চিল ব্রাদার্স ক্লাবেও সমান সফল হয়েছেন ময়দানের 'ভোম্বলদা'। তবে, তিনি কটি ট্রফি জিতেছেন, শুধু তাই দিয়ে ভারতীয় ফুটবলে (Indian Football) সুভাষ ভৌমিকের গুরুত্ব বিচার করা যায় না। বিচার করতে হবে, ভারতীয় ফুটবল নিয়ে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তার নিরিখে।
সুভাষ ভৌমিক, প্রথমবার ইস্টবেঙ্গল (East Bengal) ক্লাবের কোচিং-এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯৯৯-২০০০'এ। প্রথমবার আশানুরূপ সাফল্য না এলেও, তাঁর কোচিং জীবনের সেরা সময়টা কেটেছিল লাল-হলুদেই, ২০০২ থেকে ২০০৫ - এই তিন বছর। ২০০২-০৩ এবং ২০০৩-০৪ পরপর দুই মরসুমে তাঁর কোচিং-এ জাতীয় লিগ, অর্থাৎ এখনকার আই লিগ (i-League) জিতেছিল মশাল বাহিনী। আর, ২০০৩-এই ইন্দোনেশিয়ার (Indonasia) মাটিতে লেখা হয়েছিল, গর্বের আশিয়ান কাপ (ASEAN Cup) জয়ের ইতিহাস। আমন্ত্রিত দল হিসাবে এই টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে, শেষ পর্যন্ত নিজেদের ক্ষমতাকে ছাপিয়ে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছিল লাল-হলুদ।
তবে, জয়ের আগে ছিল প্রস্তুতি পর্ব। সেই সময় ভারতীয় ফুটবলারদের বিদেশি টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়া মানে ছিল, 'অংশগ্রহণটাই বড় কথা'। আর এই মানসিকতাকেই গোড়া ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন সুভাষ ভৌমিক। টুর্নামেন্টের আগে প্রস্তুতি পর্ব হিসাবে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের পাশের পাঁচতারা হোটেলে এনে তুলেছিলেন লাল-হলুদ ফুটবলারদের। সেই সময় ভারতীয় ফুটবলে পাঁচ তারা হোটেল, স্বপ্নের মতো বিষয়। সেই সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অনুশীলনে প্রথমবার ভারতীয় ফুটবল দেখেছিল, জাকুজি, আইসবাথ, প্যারাসুট ট্রেনিং। ক্লাব কর্তারা এত খরচে রাজি না থাকলেও, ডাকাবুকো ভোম্বলের কথার বিরোধিতা করতে পারেননি তাঁরা।
তবে শুধু প্রস্তুতিই সার ছিল না। পিকের আদরের 'ভোম্বলবাবু', তাঁর গুরুর ভোকাল টনিক তো রপ্ত করেইছিলেন, সেই সঙ্গে নিয়মিত ছিল তাঁর বিদেশি ফুটবলের চর্চা। ইস্টবেঙ্গলে তাঁর কোচিং-এ খেলে যাওয়া বিদেশি ফুটবলার ডগলাস থেকে শুরু করে মাইক ওকোরো - সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, বিদেশি ফুটবলারদের দেখভাল কীভাবে করতে হবে, তাদের কীভাবে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখা যাবে - এসব ছিল ভোম্বলদার নখদর্পণে। সেইসঙ্গে দলের সকল ফুটবলারদের সঙ্গে তিনি মিশতেন একেবারে বন্ধুর মতো। তাদের সুখ-দুঃখের খেয়াল রাখতেন। প্রয়োজনে বকাবকি করতেন, আবার বুকেও টেনে নিতেন। আর এই সব কিছুর মিশেলে জাকার্তার মাঠে, লাল-হলুদ ফুল ফুটিয়েছিল সেই ইস্টবেঙ্গল দল। দেখিয়ে দিয়েছিল, লড়াইই হল বাঙাল ক্লাবের আসল পরিচয়।
আজ ভারতীয় ফুটবলে আইএসএল চালু হয়েছে। শুরুর সময়, বলা হয়েছিল, এই টুর্নামেন্ট ভারতীয় ফুটবলকে পরবর্তী স্তরে পৌঁছে দেবে। কিন্তু, বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পরও, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় ফুটবল একই জায়গায় আটকে রয়েছে। অথচ, প্রায় দুই দশক আগেই রাস্তাটা দেখিয়েছিলেন সুভাষ ভৌমিক। বিদেশি দলের সঙ্গে নিয়মিত সংঘাতে যেতে হবে। আত্মবিশ্বাসটা জাগাতে হবে, আমরাও পারি। যে আত্মবিশ্বাসের জোরে বাইচুং ভুটিয়া, মাইক ওকোরো, ডগলাসদের নিয়ে, প্রবল পরাক্রমী থাই ক্লাব, বেক তেরো সাসানাকে (Bec Tero Sasana) পর্যুদস্ত করে প্রথমবারের আশিয়ান কাপ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। ইতিহাস বলছে, আশিয়ান সদস্য নয়, এমন আর কোনও দেশের ক্লাব আর আশিয়ান কাপ জিততে পারেনি।