ময়দানে বিখ্যাত ছিলেন ভোকাল টনিক কোচ নামেই। তাঁর ভোকাল টনিকের জোরেই নাকি হারা ম্যাচেও জিতে মাঠ ছাড়তেন প্লেয়াররা। ৭৫-এ মোহনবাগানকে ইষ্টবেঙ্গলের ৫-০ গোলে হারানোর রেকর্ডও তারই কোচিংয়ে। যা আজও অটুট। ৯৭ সালের ঐতিহাসিক ফেডকাপের সেমিফাইনালে মোহনবাগান কোচ অমল দত্তের অপ্রতিরোধ্য ডায়মন্ড ছককে নিজের মগজাস্ত্র দিয়ে নাস্তানাবুদ করেছিলেন তৎকালীন ইষ্টবেঙ্গল কোচ পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু কোচ হিসেবেই নয় প্লেয়ার হিসেবেও ভারতীয় ফুটবলে পিকের অবদান চিরস্মরণীয়।
আরও পড়ুনঃভারতীয় ফুটবলে যুগের অবসান, প্রয়াত কিংবদন্তী পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৩৬ সালের ২৩ জুন জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। ছোট বেলা থেকেই ফুটবলই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ফুটবলই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই বিহারের হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর বাবার চাকরি সূত্রে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার চলে আসে কলকাতায়। পিকে যোগ দেন এরিয়ানে ক্লাবে। ১৯৫৪ সালে একটি মরসুম এরিয়ানের হয়ে খেলেন পিকে। তারপর ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত ইষ্টার্ন রেলে ছিলেন তিনি। গোটা ময়দান এককথায় ইষ্টার্ন রেলকে চিনত পিকের ক্লাব হিসেবে। ১৯৫৮ সালে তাঁর নেতৃত্বেই কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ জিতেছিল ইস্টার্নে রেল। সেইসময় তিন বড় ক্লাব ইষ্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মহামেডানের বাইরে কোনও দল ট্রফি জিততে পারে তা ভাবাই যেত না। পিকের পায়ের যাদুতে সম্ভব হয়েছিল সেই অসম্ভবও।
আরও পড়ুনঃ'স্বাস্থ্য় সচেতন কোচ ছিলেন পিকে', করোনা আতঙ্কে শেষ যাত্রায় ভিড় কমানোর পরামর্শ মন্ত্রীর
ভারতের হয়ে তিনটি এশিয়ান গেমসে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৮ সালে টোকিও, ১৯৬২ সালে জাকার্তা এবং ১৯৬৬ সালে ব্যাঙ্ককে। ১৯৬২ সালের এশিয়াডে ফুটবলে ভারতের সোনা জয়ের পিছনে তিনি ছিলেন অন্যতম কারিগর। সঙ্গে ছিলেন চুনি গোস্বামী, তুলসীদাস বলরাম, জার্নাল সিং, পিটার থঙ্গরাজদের মত চিরস্মরণীয় প্লেয়ারা। ১৯৫৬ সালে প্রথম বার মেলবোর্নে অলিম্পিকসে খেলেন পিকে। ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে তিনিই ছিলেন ভারতীয় টিমের ক্যাপ্টেন। ভারতের জার্সি গায়ে ৪৫টি ম্যাচ খেলেছিলেন পিকে। তাঁর বুট থেকে এসেছিল ১৪টি গোল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বারবার ঝলসে উঠেছিলেন পাঁচফুট সাড়ে আট ইঞ্চির এই স্ট্রাইকার।
আরও পড়ুনঃকরোনা ভাইরাস রুখতে ভিডিও বার্তা সচিনের, কী বললেন মাস্টার ব্লাস্টার
প্লেয়ার জীবনে সাফল্যের সৌজন্যে ১৯৬১ সালে অর্জুন পুরষ্কার পান প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৪ সালে পান পদ্মশ্রী পুরস্কার। খেলা ছাড়ার পর কোচিংয়েও নজরকাড়া সাফল্য পেয়েছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় দলের কোচিং করার দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি কোচিং করিয়েছিলেন ময়দানেও। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন পর্বে তিনি প্রথমবার দেশের কোচিং করান। টানা ১৪ বছর ছিলেন ভারতীয় টিমের কোচ। ১৯৭৫ সালে ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে ৫-০ গোলের হারানোর সময়ও লাল-হলুদের কোচ ছিলেন পিকে। ১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে পিকে এবং মোহনবাগানের কোচ অমল দত্তর লড়াই ইতিহাস হয়ে রয়েছে ময়দানে। ওই ম্যাচেই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ১ লক্ষ ২০ হাজার দর্শক হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত যা ভারতীয় ফুটবলে রেকর্ড। সেই ম্যাচে অমল দত্তর ডায়মন্ড সিস্টেমকে মাটিতে মিশিয়ে ছেড়েছিল পিকের ছক। ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে হ্যাটট্রিক করেছিলেন বাইচুং ভুটিয়া। মোহনবাগানকে ৪-১ গোলে হারিয়েছিল পিকের লাল-হলুদ।
তারপর থেকেই শারীরিক অসুস্থতা ও নান কারণে কোচিং থেকে সরে আসেন পিকে। তার জায়গায় তখন ময়দানের বড় বড় ক্লাবে কোচিং করাচ্ছেন সুভাষ ভৌমিক, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুব্রত ভট্টাচার্য, মিহির বসুর মতো তাঁর একঝাঁক দিকপাল ছাত্র। মাঝে ২০০৫ সালে ফিফার তরফ থেকে সম্মান জানানো হয় পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শতাব্দীর সেরা ফুটবলারের সম্মানে তাঁকে সন্মানিত করে ফিফা। অবশেষে দীর্ঘ ফুটবল ও কোচিং কেরিয়ারের শেষে ২০ মার্চ, ২০২০ সালে নিঃশব্দে চলে গেলেন ভোকাল টনিক কোচ। শুধু তাঁর স্মৃতি পড়ে রইল ময়দানের সবুজ ঘাসে।