১১ বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন কেরলের পলক্কড় জেলার মেয়ে সাজিথা। ঘরের বাইরে ইলেকট্রিকের বেড়া দিয়েছিল প্রেমিক রহমান।
প্রেমের সেরা উদাহরণ, নাকি এর পিছনে অন্য কোনও গল্প লুকিয়ে আছে? আসলে গোটা বিষয়টা এতটাই বিস্ময়কর, যে সকলের পক্ষেই হজম করতে অসুবিধা হচ্ছে। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ ছিলেন কেরলের পলক্কড় জেলার মেয়ে সাজিথা। অবশেষে জানা গেল, এই এতগুলো বছর ধরে তাঁকে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেকেছিল তাঁর প্রেমিক, আলিঞ্চুভাত্তিল রহমান। আর এতটাই গোপনে, যে তার পরিবারের কেউ, ঘুণাক্ষরেও তাঁদের বাড়িতে সাজিথার উপস্থিতি টের পাননি। অবশেষে, বুধবার বৈধভাবে বিয়ে করলেন তাঁরা।
পলক্কড় জেলার আড়িয়ালুর শহরে থাকেন ভেল্যুধন ও সাঁথা। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের তিন মেয়ের মধ্যমজন, সাজিথা আচমকা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে আর ফেরেননি। এই বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ করা হলেও, পুলিশ তাঁর খোঁজ পায়নি। রহমানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সাজিথার বাবা সন্দেহভাজনদের তালিকায় তাঁর নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু, রহমান কোথাও পালায়নি বলে সন্দেহমুক্ত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত, তাঁর পরিবারও তাঁকে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল গ্রামের লোকও। কেউ কেউ ভেবেছিল, তিনি কারও সঙ্গে পালিয়ে তামিলনাড়ু চলে গিয়েছেন।
এদিকে, সাজিথা ও রহমানের মতে সাজিথা লুকিয়ে ছিলেন তাঁর বাড়ি থেকে মাত্র একশ মিটার দূরেই। রহমানের বাবা-মা আলি়ঞ্চুভাত্তিল মুহাম্মদ গনি এবং আথিক্কার বাড়িতে। পেশায় দিনমজুর এই দম্পতির রহমান ছাড়াও বশির নামে আরেক ছেলে-সহ চার সন্তান রয়েছে। এক মেয়ে বিবাহিত, আরেকজন অসুস্থ, বাড়িতেই থাকে। বাড়িতে তিনটে ঘর, একটি রান্নাঘর। শৌচাগার, স্নানের জায়গা বাইরে। এই বাড়িতেই রহমানের ছোট্ট ঘরে এতদিন লুকিয়ে ছিলেন সাজিথা। রহমানের বাবা-মা অবশ্য এখনও এই কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
তবে পুলিশ মনে করছে, তাদের গল্পটা অস্বাভাবিক হলেও সত্যি। কীভাবে ঘটেছিল এই অজ্ঢাতবাসের শুরু? রহমান জানিয়েছেন, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের প্রেম ছিল। একদিন সাজিথা তাঁকে বলেছিল, সে আর তার বাড়িতে থাকতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে রহমান তাকে তাঁর কাছে চলে আসতে বলেছিলেন। পরিকল্পনা ছিল, কয়েকদিন পর দুজনে অন্য কোথাও চলে যাবেন। রহমানের কিছু অর্থ প্রাপ্তির কথা ছিল। তা পেতে দেরি হয়েছিল, আর সেই টাকাটা তার পরিবার নিয়ে নিয়েছিল। তাই ওই ঘরেই আটকে পড়েছিলেন সাজিথা। কেউ ভাবেননি, সেই ব্যবস্থা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলবে।
কীভাবে সকলের চোখে ধুলো দিলেন হরমান? তার ভাই বশির জানিয়েছেন, রহমানের একটি আলাদা ঘর ছিল, যা সে বাড়িতে না থাকলেই তালাবদ্ধ করে রাখত। কাউকে সেই ঘরে ঢুকতে দিত না। মেজাজ গরম বলে তাদের বাবা-মাও রহমানকে বেশি ঘাঁটাতেন না। কেউ তার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলেই হিংস্র হয়ে উঠত রহমান। এমনকী তার খাবারও সে ঘরে নিয়ে গিয়ে খেত। রহমান ইলেকট্রিক্যাল কাজে দক্ষ। পরিবারের সকলকে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, যদি কেউ তার ঘরের বাইরের তারে হাত দেয় বা ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের ইলেকট্রিকাল শক লাগবে। পরিবারের এক-দুইজন পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন।
সাজিথা কীভাবে এতদিন কাটালেন ওই ঘুপচি ঘরে? দিনের বেলা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য, তিনি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করতেন। রাতে, কিংবা বাড়িতে যখন অন্য কেউ থাকত না, সেই সময়ই তিনি বেরিয়ে বাইরে যেতেন শৌচকর্ম করতে। এমনকী, ধোওয়া জলে ভেজা কাপড়-চোপরও তিনি ঘরের ভিতরেই শুকিয়ে নিতেন। রহমান একটি ছোট টিভি এনে দিয়েছিলেন, বেশিরভাগ সময় কানে ইয়ারফোন দিয়ে তিনি সেই টিভি দেখতেন। আর, রহমান নিজের জন্য খাবার ঘরে নিয়ে এসে প্রেমিকার সঙ্গে ভাগ করে খেত। জ্বর হলে প্যারাসিটামল খেয়ে নিতেন সাজিথা, তবে এই এক দশকেরও বেশি সময়ে তাঁর কখনও কোনও বড় স্বাস্থ্যগত সমস্যা হয়নি।
অবশেষে বশির-এর জন্যই ধরা পড়ে যায় রহমান ও সাজিথার এই অজ্ঞাতবাস। পুলিশকেও খবর দিয়েছিল সে। সেটা চলতি বছরের জুন মাস। তাকে অনুসরণ করে গিয়ে পুলিশ ৩৫ বছরের সাজিথার খোঁজ পেয়েছিল। সামনে এসেছিল তাদের লিভ-ইন সম্পর্কের কথা। এরপর বুধবার নেনমারা সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে এক সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সইসাবুদ করে বিয়ে করলেন। স্থানীয় বিধায়ক কে বাবু সস্ত্রীক, নবদম্পতিকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানান। সাজিথার বাবা -মা, ভেল্যুধন এবং সাঁথার উপস্থিত থাকলেও রহমানের বাবা -মা বা কোনও আত্মীয় আসেননি।
স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য এই দম্পতির প্রেম ও বিয়ে নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত। তাঁদের দাবি, এটাই প্রেমের সেরা উদাহরণ। তবে সকলে একটা প্রশ্ন করছেনই, এত ছোট ঘরে এতদিন ধরে তারা রইলেন, একবারও ঝগড়া হল না?