
ভারত আগামী বছর দিল্লিতে আয়োজন হবে ওয়ার্ল্ড সার্কুলার ইকনমি ফোরাম (WCEF) — যা এশিয়ায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। বৃহস্পতিবার কলকাতায় ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স (ICC) আয়োজিত এক বিশেষ ইন্টারঅ্যাক্টিভ সেশনে এই ঘোষণা করেন ভারতে নিযুক্ত ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত কিম্মো লাহদেভিরতা। রাষ্ট্রদূত জানান, এই আন্তর্জাতিক ফোরামটি অনুষ্ঠিত হবে ফিনল্যান্ডের উদ্ভাবনী তহবিল সংস্থা Sitra–র সহযোগিতায়। তাঁর কথায়, “কলকাতা ও পূর্ব ভারতের সঙ্গে ফিনল্যান্ডের সম্পর্ক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী বছর দিল্লিতে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড সার্কুলার ইকনমি ফোরাম ফিনল্যান্ড–ভারত সহযোগিতার এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে উঠবে। টেকসই উন্নয়ন, উদ্ভাবন এবং সার্কুলার ইকনমির ক্ষেত্রে আমাদের দুই দেশের অংশীদারিত্বকে এটি আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
লাহদেভিরতা বলেন, “ফিনল্যান্ড ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ১৯৪৯ সালে। আজ শতাধিক ফিনিশ কোম্পানি ভারতে সক্রিয়, যার মধ্যে অন্তত আটটি কাজ করছে পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ক্রমেই মজবুত হচ্ছে ব্যবসা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে।” রাষ্ট্রদূতের মতে, “পূর্ব ও উত্তর–পূর্ব ভারতের অঞ্চল—বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ—ফিনল্যান্ড–ভারত সহযোগিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে সমুদ্রবন্দর, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বাজারে প্রবেশাধিকার, কৃষি–শিল্পের সম্ভাবনা, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস এবং দক্ষ মানবসম্পদ। এই সমস্ত দিকই পূর্ব ভারতকে যৌথ উদ্যোগ ও শিল্প–বিনিয়োগের জন্য আদর্শ ক্ষেত্র করে তুলেছে।”
তিনি আরও বলেন, “কলকাতা ও পূর্ব ভারতের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা মূলত বাণিজ্য, ব্যবসা এবং উদ্ভাবন–কেন্দ্রিক। ফিনল্যান্ডের শক্তি আমাদের নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বমানের শিক্ষা, পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনায়। এগুলি পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।” লাহদেভিরতা জানান, ফিনল্যান্ডের রফতানি প্রচারের কাঠামো এখন ‘DESI’— অর্থাৎ Digitalisation, Education, Sustainability, Innovation—এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘M’, যার অর্থ Mobility। “এই সংযোজন প্রতীকীভাবে দুই দেশের মধ্যে বিনিময় ও সংযোগের সম্প্রসারিত পরিসরকে তুলে ধরে,”।
তাঁর মতে, “সরকারি প্রতিনিধিদের ভূমিকা সহযোগিতার পথ তৈরি করা, কিন্তু প্রকৃত অগ্রগতির চালিকাশক্তি ব্যবসা ও শিল্পক্ষেত্র। আইসিসি–র সদস্যরা ভারতের পূর্বাঞ্চলে নতুন প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হয়ে উঠছেন।” তিনি বলেন, “ফিনল্যান্ড–ভারত সম্পর্ক কেবল বাণিজ্য বা বিনিয়োগ নয়, এটি যৌথ মূল্য সৃষ্টি ও সামাজিক–পরিবেশগত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল বিভাজন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি—এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলিতে শিল্পক্ষেত্রকেই নেতৃত্ব নিতে হবে।”
রাষ্ট্রদূত লাহদেভিরতার বক্তব্যে উঠে আসে ফিনল্যান্ডের শক্তি—পরিষ্কার শক্তি, স্মার্ট গ্রিড, বর্জ্য–থেকে–মূল্য সৃষ্টির প্রযুক্তি, জল পরিশোধন এবং টেকসই পরিবহন। তাঁর মতে, “ভারতের বিশাল বাজার ও উদ্যমী শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা যুক্ত হলে ফলাফল হবে সত্যিই রূপান্তরমূলক।” তিনি আরও যোগ করেন, “ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ও ডিজিটাল দক্ষতা ভারতের স্টার্ট–আপ সংস্কৃতি ও উদ্ভাবনী ক্লাস্টারের সঙ্গে মিলে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। এ বছর ফ্রান্সে চালু হওয়া AI Coalition–এর সদস্য হিসেবে দুই দেশই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উদীয়মান প্রযুক্তিতে যৌথ প্রতিশ্রুতির পথ ধরেছে।”
লাহদেভিরতা বলেন, “ফিনল্যান্ডে আমরা বিশ্বাস করি ব্যবসায়িক সাফল্য ও সামাজিক কল্যাণ পাশাপাশি চলে। যে সমাজ আস্থার, স্বচ্ছতার ও উদ্ভাবনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, সেটিই সবচেয়ে স্থিতিশীল। ভারত তার পরবর্তী উন্নয়ন পর্বে প্রবেশ করছে, যেখানে এই নীতিগুলি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ফিনল্যান্ড ও ভারত একসঙ্গে কাজ করে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।” সভায় ফিনল্যান্ড দূতাবাসের কাউন্সেলর সান্না ওরাভা বলেন, “ফিনল্যান্ড জাতিসংঘের হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে টেকসই দেশ, সরকার পরিচালনায় শীর্ষে, আর পরপর আট বছর বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে স্বীকৃত। আমরা প্রশাসনিক স্থিতিশীলতায়ও সেরা। শিক্ষা, উদ্ভাবন, ও সবুজ প্রযুক্তিতে আমাদের দক্ষতা ভারতীয় বাজারের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করছে।”
তিনি জানান, “বর্তমানে ভারতে শতাধিক ফিনিশ সংস্থা কাজ করছে, যারা ভারতের বাজারকে ইউরোপে প্রবেশের সেতু হিসেবে দেখছে। সরাসরি দিল্লি–হেলসিঙ্কি বিমান পরিষেবা, কম করহার, এবং শক্তিশালী কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক—সব মিলিয়ে ভারত ফিনল্যান্ডের কাছে এক কৌশলগত ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার।” আইসিসি রেলওয়ে কমিটির চেয়ারম্যান ও জুপিটার ওয়াগনস লিমিটেডের ডিরেক্টর বিকাশ লোহিয়া বলেন, “ভারত–ফিনল্যান্ড সম্পর্ক বহুদিনের এবং উদ্ভাবন, বিজ্ঞান ও টেকসই উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। স্মার্ট সিটিজ মিশন, নবায়নযোগ্য শক্তি ও ডিজিটাল রূপান্তরে ফিনল্যান্ডের অবদান উল্লেখযোগ্য।” আইসিসি–র ডিরেক্টর জেনারেল রাজীব সিং বলেন, “পরিসংখ্যান বা র্যাঙ্কিং নয়, অগ্রগতির প্রকৃত পরিমাপ হয় প্রভাবের মাধ্যমে—যা আমরা একসঙ্গে সৃষ্টি করি। ভারত ও ফিনল্যান্ডের যৌথ প্রচেষ্টা সেই প্রভাবকে বাস্তব রূপ দেবে।”