
কথায় বলে বামন (Dwarf) হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো। এই ক্ষেত্রে চাঁদ না হলেও মাত্র তিন ফুট উচ্চতার এক ব্যক্তি, হাতে পেলেন গাড়ির স্টিয়ারিং। যা, একজন বামনের কাছে, হাতে চাঁদ পাওয়ার থেকে কম কিছু না। কারণ, আমাদের দেশে এই প্রথম কোনও বামন ব্যক্তিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স (Driving License) দেওয়া হল। এর থেকেই তাঁর কৃতিত্বের ভারটা অনুভব করা সম্ভব। স্রেফ আত্মমর্যাদা বোধ আর ইচ্ছাশক্তির জোরে কতদূর পৌঁছনো যায়, তার নজির গড়লেন হায়দরাবাদের বাসিন্দা গাট্টিপল্লী শিবপাল (Gattipally Shivpal)।
এখন তাঁর বয়স ৪২ বছর। তবে নিজে একটি গাড়ি কিনে, সেই গাড়ি চালাবেন - এই লক্ষ্যটা নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন অনেকদিন আগে। শিবপালের জন্ম তেলেঙ্গানার করিমনগর (Karimnagar, Telangana) জেলায়। সেখান থেকেই ২০০৪ সালে প্রতিবন্ধী কোটায় গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। কিন্তু, বামন বলে তাঁকে কেউ চাকরি দিতে চাননি। প্রথমে বিনোদন জগতে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করেছিলেন। একটি চলচ্চিত্র এবং একটি ধারাবাহিকে অভিনয়ও করেন, কিন্তু সেই লাইনে বেশি দিন টিকতে পারেননি।
এরপর এক বন্ধুর বদান্যতায় তিনি একটি প্রাইভেট সংস্থায় চাকরি পেয়েছিলেন। সেখানেই গত ২০ বছর ধরে মর্যাদার সঙ্গে কাজ করছেন শিবপাল। রুটি-রুজির সংস্থান হওয়ার পরও তাঁকে প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হত। কাজে যাওয়ার জন্য, ট্যাক্সি বুক করলে, তারা তাঁর উচ্চতা দেখে রাইড বাতিল করত। স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে গেলেও, রাস্তার লোকজন কটু মন্তব্য করতে ছাড়েনি। সেই সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, একটি গাড়ি কিনবেন এবং নিজেই সেটি চালিয়ে টিটকিরিবাজদের দেখিয়ে দেবেন।
ড্রাইভিং শিখতে চান, কিন্তু, গাড়ি চালাবেন কী করে? সাধারণ গাড়ির সিটে বসে তিনি সামনে কিছু দেখতে পান না। পাও পৌঁছায় না অ্যাক্সিলেটর-ব্রেক-ক্লাচ পর্যন্ত। এখানেই তাঁর সহায় হয় ইন্টারনেট। সেখানে খুঁজতে খুঁজতে শিবপাল, এক মার্কিন ব্যক্তির আপলোড করা ভিডিও দেখে বুঝতে পারেন, তাঁর উচ্চতার কোনও ব্যক্তিকে গাড়ি চালাতে গেলে, কোনও গাড়ির আসন এবং অন্যান্য সরঞ্জামে কী কী পরিবর্তনগুলি আনতে হবে।
এরপর একটি গাড়িকে প্রয়োজন অনুসারে মডিফাইও করে ফেলেছিলেন শিবপাল। তারপর, সেই গাড়িতে এক বন্ধুর কাছ থেকে গাড়ি চালানো শিখেছিলেন। তবে গাড়ি চালাতে শুরু করেও তাঁর লড়াই শেষ হয়নি। পরের চ্যালেঞ্জ ছিল লাইসেন্স পাওয়া। ভারতে, গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার জন্য পরিবহন দফতরের নির্দিষ্ট উচ্চতা বেঁধে দিয়েছে। তবে, তাঁর মডিফাই করা গাড়ি এবং তাঁর গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে, কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁকে বিশেষ লাইসেন্স দেওয়ার আবেদন করেছিলেন শিবপাল।
তাঁর অবস্থা বিচার করে পরিবহন দফতর তাঁকে প্রথমে তিন মাসের জন্য একটি 'লার্নার্স লাইসেন্স' দেয়, এবং তারপর পরিবহন দফতরের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা দিয়ে এখন পূর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছেন গাট্টিপল্লী শিবপাল। সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে তিনি জানিয়েছেন, উচ্চতার কারণে একসময় সমাজ তাঁকে নিয়ে মস্করা করত। আর এই কৃতিত্বের পর 'লিমকা বুক অফ রেকর্ডস' (Limca Book of Records)-সহ আরও বেশ কয়েকটি সম্মানের জন্য মনোনীত হয়েছেন তিনি। বলেছেন, প্রত্যেকেরই মধ্যে কিছু খামতি থাকে, তবে নিজের লুকানো প্রতিভাটা খুঁজে পাওয়াই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।
একইসঙ্গে, তাঁর এই কৃতিত্ব, দেশের অনেক বামন মানুষকেই গাড়ি চালানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। অনেকেই ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন। এই অবস্থায়, শিবপাল ছিক করেছেন, পরের বছর শুধু বামন নয়, অন্যান্য শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি ড্রাইভিং স্কুল চালু করবেন।