তপন মল্লিক- প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ এই দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। মানবাধিকার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রতি ৫ বছর অন্তর জাতিসংঘ পুরস্কার দেওয়া হয়। মানবাধিকার মৌলিক অধিকার হলেও সে অধিকার লংঘিত হচ্ছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। এখনও সব মানুষের জন্য নেই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, নেই স্বাস্থ্য,শিক্ষা। প্রতি মুহুর্তে বাঁধা পাচ্ছে তার রাজনৈতিক অধিকার, মুক্ত চিন্তাভাবনার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার। এ ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বের তুলনায় অনেক এগিয়ে আমাদের দেশ।
ভয়াবহ করোনাকালে দেশের উচ্চ আদালত সমস্ত জেল থেকে বন্দি কমানোর কথা বলেছিল। কিন্তু সে কথায কানে তোলেননি মোদী সরকার। উল্টে ঠিক সেই সময়েই সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয়। ভারাভারা রাও, অখিল গগৈ, অমিতাভ বাগচি, শরজিল ইমামের মতো বহু বন্দি করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও তাদের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়নি। বহু জেলে করোনার প্রকোপ বাড়ার পর নির্বিকার থাকে সরকার। কিছুদিন আগেও ভিমা কোরেগাঁও মামলায় জড়িয়ে দিল্লিতে গ্রেফতার করা হয় অধ্যাপক হানি বাবুকে।
ওঁরা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলে বন্দি থাকা রাজনৈতিক বন্দিদের একটা বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের বয়সজনিত শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন৷ যে সমস্যা আরও বেড়েছে জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে। উদাহরণ অসংখ্য, যেমন মহারাষ্ট্রের জেলে বন্দি থাকা ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক জি এন সাইবাবা, কবি ভারভারা রাও, অধ্যাপক সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ প্রমুখ। পাশাপাশি, কেরালার জেলে বন্দি ইব্রাহিম ব্লাড সুগার ও হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। একটি মাত্র মামলায় জামিনের অপেক্ষায় থাকা ইব্রাহিমের তরফে বারবার জামিনের আর্জি জানানো হলেও তা নাকচ হয়েছে। একই পরিস্থিতি দানিশ-এর ক্ষেত্রে। কিডনির সমস্যায় ভুগছেন তিনি। সব কটি মামলায় জামিন পেলেও নানা কারণ দেখিয়ে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।
পিছিয়ে নেই এ রাজ্য। ক্ষমতায় আসার আগে সব রাজনৈতিক দলই রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়, তারপর তা ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়। ভোটে জিতেও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করতে পারেনি কেউ। এ রাজ্যে ১৯৭৭ সালে প্রথমবার বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে, তখন নতুন সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। কিন্তু তারপর?
২০১১ সালে এ রাজ্যে পালাবদল ঘটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগেই রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করতে ১৩ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু তৃণমূল কই সে কথা রেখেছে? অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ ডেমোক্র্যাটিক রাইটসের কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের সদস্য রণজিৎ সুর জানান, বামফ্রন্ট সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও তৃণমূল সরকার তা করেনি। ২০১১ সালে দুশোরও বেশি রাজনৈতিক বন্দি ছিল রাজ্যে। তার মধ্যে যাঁরা জামিন পেয়েছেন বা আদালত যাঁদের মুক্ত করেছে শুধুমাত্র তাঁরাই ছাড়া পেয়েছেন।
এরপর ২০১৩ সালে তৃণমূল সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের সংজ্ঞাই বদলে দেয়। যে কারণে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকারের কমিটি ৫২ জন বন্দির একটি তালিকা দিয়েছিল। কিন্তু পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মাওবাদি বন্দিদের মুক্ত করার ব্যাপারে রাজ্যকে সাবধান করে দেয়।
এই মুহুর্তে রাজ্যে বিধানসভা ভোটের দামামা বাজছে। ফের রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দলের মুখে শোনা যাচ্ছে সেই পুরনো প্রতিশ্রুতি পূরণের কথা। ক্ষমতায় এলে রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ। বলেছেন, তিনি জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে তৃণমূল–সহ সমস্ত দলের জেলবন্দি নেতাকর্মীদের ছেড়ে দেওয়া হবে, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলাও প্রত্যাহার করা হবে। তিনি এও বলেন, কেবল বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নয়, মিথ্যা মামলায় জড়িত সিপিএম এবং কংগ্রেস কর্মীদের মামলাও প্রত্যাহার করা হবে।
কিন্তু ইতিহাস যে অন্য কথা বলে। ভোটের আগে ক্ষমতায় আসার জন্য, এমনকি ভোটে জিতে ক্ষমতা লাভ করেও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি গত চার দশকের বেশি সময়কালে বার বার মিথ্যে প্রমানিত হয়েছে। আজ জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার দিবসে আরও একবার সে কথা মনে পড়ল।