৩৬ টি রাফাল ফাইটার জেট বিমান ক্রয়ের ক্ষেত্রে ফরাসি প্রতিরক্ষা সংস্থা ডাসল্ট এভিয়েশন ও এমবিডিএকে যে 'ব্যতিক্রমী ও অভূতপূর্ব' ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তা বকলমে মেনে নিল কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারি এক সূত্রের দাবি, রাফাল চুক্তির সময় প্রতিরক্ষা ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তির ধারাগুলি পাল্টে ফেলা হয় ঠিকই, তবে তা করা হয়েছিল দেশেরই স্বার্থে, 'অফসেট অবলিগেশন'-এর এফেক্টিভ ডিসচার্জ-এর জন্য।
রাফাল চুক্তি নিয়ে অস্বস্তি ক্রমেই বাড়ছে মোদী সরকারের। ভারতের শীর্ষ আদালত রাফাল মামলার রায় পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, এবার এক ফরাসী পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা গেল ২০১৫ সালে মোদীর রাফাল ক্রয়ের ঘোষণার পরই অনিল আম্বানির ফরাসি টেলিকম সংস্থাকে ১৪৩.৭ মিলিয়ন উইরো কর ছাড় দিয়েছিল ফরাসী কর্তৃপক্ষ। স্বাভাবিকভাবেই এর পিছনে রাফাল চুক্তির ভূমিকা আছে কি না, তাই নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
ফরাসী পত্রিকা 'লে মঁদে'-র এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে ফ্রান্সে নথিভুক্ত অনিল আম্বানির টেলিকম সংস্থা 'রিলায়েন্স আটলান্টিক ফ্ল্যাগ ফ্রান্স' সংস্থার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি দেওয়ার তদন্ত করেছিল ফরাসী কর বিভাগ। দেখা যায় ২০০৭ থেকে ২০১০ মধ্যে ৬০ মিলিয়ন উইরো কর ফাঁকি দিয়েছিল অনিল আম্বানির ওই সংস্থা।
ফরাসী কর বিভাগকে মাত্র ৭.৬ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে বিষয়টি মেটাতে চেয়েছিলেন অনিল আম্বানি। কিন্তু ফরাসী কর্তৃপক্ষ তখন তাতে রাজি তো হয়ইনি, উল্টে আরও তদন্তে তারা ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্য়ে আরও ৯১ মিলিয়ন ইউরো কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় 'ফ্ল্যাগ ফ্রান্স'-এর বিরুদ্ধে।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্যারিস সফরে গিয়ে হঠাতই ফরাসী সংস্থা ডাসল্ট অ্যাভিয়েশনের কাছ থেকে সরাসরি 'ফ্লাই অ্যাওয়ে' অবস্থায় থাকা ৩৬টি রাফাল ফাইটার জেট বিমান ক্রয়ের কথা ঘোষণা করে দেন। 'লে মঁদে'-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এরপর হঠাত করেই আম্বানির সংস্থা নিয়ে সুর বদলে যায় ফরাসি কর বিভাগের। ১৫১ মিলিয়ন ইউরোর কর ফাঁকির মামলা রাফাল ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে মাত্র ৭.৩ মিলিয়ন ইউরোতেই মিটিয়ে নেয় তারা।
২০১৫ সালের অক্টোবর মাস থেকে রাপাল চুক্তি নিয়ে ভারত ও ফ্লান্স দর কষাকষি শুরু করে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৫০ শতাংশ 'অফসেট ক্লজ'-সহ ৭.৮৭ বিলিয়ন ইউরোর আন্তঃ সরকার চুক্তি সাক্ষর করে দুই দেশ। রাফাল-এর প্রস্তুতকারী ডাসল্ট অ্যাভিয়েশন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা অনিল আম্বানির সংস্থাকেই তাদের অফসেট পার্টনার হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
এই বাছাই নিয়েই বিতর্ক দানা বেঁধেছে। রাফাল ঘোষণার সময় ফরাসী প্রেসিডেন্টের পদে থাকা ফাঁসোয়া ওলাঁদ দাবি করেছিলেন চুক্তিপত্রেই অফসেট পার্টনার হিসেবে অনিলের সংস্থার কথা উল্লেখ করা ছিল। তাই এই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের হাতে কোনও বিকল্প ছিল না। ওই একই সময়ে অনিলের টেলিকম সংস্থাকে ফরাসী কর্তৃপক্ষ কর ছাড় দেওয়ায়, এর পিছনে রাফাল চুক্তির কোনও ভূমিকা ছিল কি না তাই নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
এর আগে 'দ্য হিন্দু' পত্রিকায় প্রকাশিত রাফাল চুক্তির ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা গিয়েছিল ডাসল্টকে সুবিধা দিতে 'ডিফেন্স প্রকিওরেন্ট প্রসিডিওর'-এর বেশ কয়েকটি ধারা বাদ দিয়েছিল খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সরকারি আধিকারিকদের বাধাকেও তোয়াক্কা করা হয়নি।
তবে রাফাল চুক্তির সঙ্গে ফ্রান্সে তাদের সংস্থার কর মকুব হওয়ার কোনও যোগাযোগ নেই বলেই এক বিবৃতিতে দাবি করেছে রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস। সংস্থার দাবি ফরাসী কর বিভাগের ওই করের দাবি সম্পূর্ণ অস্থীতিশীল ও বেআইনি। এই ক্ষেত্রে ফ্রান্সের আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকেই কর ফাঁকির মামলাটির নিষ্পত্তি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে অনিল আম্বানির সংস্থা।
দাবি ঠিক যেই সময় প্রতিরক্ষা সংস্থা ডাসল্ট এভিয়েশন ও এমবিডিএকে যে 'ব্যতিক্রমী ও অভূতপূর্ব' ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তা বকলমে মেনে নিল কেন্দ্রীয় সরকার। সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্র এক সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্য়মের কাছে দাবি করেছে, রাফাল চুক্তির সময় প্রতিরক্ষা ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তির ধারাগুলি পাল্টে ফেলা হয় ঠিকই, তবে তা করা হয়েছিল দেশেরই স্বার্থে।
ওই সরকারি সূত্রের দাবি, এই সংক্রান্ত ধারাগুলি অত্যন্ত কঠোর ছিল। 'অফসেট অবলিগেশন'-এর এফেক্টিভ ডিসচার্জ বা বাড়তি চুক্তির সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছিল। তাই রাফাল চুক্তির আগে প্রতিরক্ষা ক্রয় সংক্রান্ত স্ট্যান্ডার্ড চুক্তিপত্রের কয়েকটি ধারা বদলে দেওয়া হয়। যার ফলে দেশের লাভই হয়েছে।
দিন কয়েক আগে অপর এক সংবাদ মাধ্যমের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, দুটি ফরাসী সংস্থাকেই ভারতের 'ডিফেন্স প্রোকিওরমেন্ট প্রসিডিওর ২০১৩'-এর স্বাভাবিক চুক্তির ধারাগুলি মেনে চলা থেকে ছাড় দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ক্যাবিনেটের প্রতিরক্ষা কমিটি।
এছাড়া, 'অসঙ্গত প্রভাব খাটানো' এবং 'এজেন্ট / এজেন্সি কমিশন' ব্যবহারে নিষেদ্ধাজ্ঞা সংক্রান্ত ডিপিপি ২০১৩-এর আরও দুটি ধারাও রাফাল চুক্তির ঠিক আগেই সরিয়ে দিয়েছিল ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিল - এরকমই অভিযোগ।
এই প্রতিবেদন নিয়ে সরকারকে নিশানা করেছিলেন সিপিআইএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরিও।