ইরানের রাজনৈতিক নির্বাচন আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার প্রভাব

  • ইরানের রাজনৈতিক নির্বাচন 
  • ক্ষমতায় কট্টোরপন্থী ইব্রাইম রাইসি 
  • তাতে প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে 
  • ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক তিক্ত 

জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইনঃ  সালটা ১৯৭৯। ইরান বিল্পব তেহরানের রাস্তাকে বদলে দিয়েছিল। পশ্চিমে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে ইরানে একটি সরকার তৈরি হয়। আর সেটি  মধ্য প্রাচ্যের ভৌগলিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমের দেশগুলিতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইরানের উচ্চাভিলাশকে কেন্দ্র করে শক্তিধরদেশগুলির মধ্যে একটি নতুন খেলা শুরু হয়েছিল। 

এক অভ্যন্তরীন রাজনীতি, ইস্যু আর বাহ্যিক বিষয়গুলিও ছিল আন্তর্জাতিক চর্চার বিষয়। মধ্য প্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য এটি ছিল যথেষ্ঠ তাৎপর্যপূর্ণ। ইরানের সঙ্গে যুক্ত কৌশলগত স্বার্থের বিভিন্ন ইস্যুগুলির মধ্যে প্রধান মতাদর্শগত  সমর্থনের উপর ভিত্তি করে শিয়া সুন্নি বিরোধের উত্থান হয়েছিল: ইরান আর সৌদি আরবে।ইরান পারস্য উপসাগরীয় অঞঅচলে আশেপাশের দেশগুলির পশ্চিমা সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ বিণিজ্য ও দ্বালানি কেন্দ্রগুলিতে প্রস্ফুটিত দেশগুলির তুলনায় পশ্চিম দিকে ক্রমাগত প্রত্যাখান করেছে।  

Latest Videos

ইরান প্রথম থেকেই সামরিক শক্তি বাড়াতে তৎপর ছিল। পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার বাড়াতে মন দিয়েছিল। তবে ইরানের অস্ত্র ভান্ডার বর্তমানে গোটা বিশ্বের কাছেই একটি রহস্য। একাধিক দেশ মনে করে ইরান খুবই শক্তিধর দেশ। 

তদুপরি উদ্বেগের অন্যতম বিষয় হল ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের শত্রুতা। দুটি দেশ এক অপরকে মান্যতা দেয় না। ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির কাছেও এটি অত্যন্ত চাপের। ইরান আরব দেশগুলির তুলনায় ফিলিস্তিতিদের অনেক বেশি কাছের। ইরান সর্বদাই নিজেরি ইসলামের শ্রেষ্ট পতাকাবাহক হিসেবে তুলে ধরতে চায়। এই দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আলাদাভাবে একটি অস্তাগার তৈরি করেছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় রীতিমত শুরু হয়েছে রণসজ্জা। 

অন্যদিকে এই দেশ প্রক্সি যোদ্ধাদের অর্থসাহায্য করে। অস্ত্র কেনা আর প্রশিক্ষণেই সাহায্যের হাত বাডিয়ে দেয়। ইরান রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস আকারে একটি শক্তিশালি বিশেষজ্ঞ সহ একাধিক উপাদান রয়েছে। যার প্রধান ভূমিকা হল ইসলামি রাষ্ট্রগুলিকে রক্ষার পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও 'বিকৃত আন্দোলন' দ্বারা বিদেশী হস্তক্ষেপ আর অভ্যুর্থান রোধে প্রধান ভূমিকা পালন করা। শেষ অবধি সিরিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় আর ইরাকে শিয়া মিলিশিয়াদের পক্ষে সমর্থন অর্জনে রাশিয়ার সঙ্গে ইরান যথেষ্টই ভালো সহযোগিতা করেছে। 

ইরানের বর্তমান দেশীয় আর আন্তর্জাতিক অবস্থা আমি ব্যাখ্যা করছি তার প্রধান কারণই হল মধ্য প্রাচ্যের প্রেক্ষাপটে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতি। এর স্থিতিশীলতা আর কৌশলগত উচ্চাকাঙ্খাগুলি মধ্য প্রাচ্যকে দ্বন্দ্বমুক্ত রাখবে কিনা আর আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কী কী পরিবর্তন আনতে পারে তা বলার জন্য। ইন্দো-প্যাসিফিকের দিকে পরিবর্তনের অনুমতি দেবে কিনা তাও অনেকাংশে নির্ভর করে ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি। 

সর্বোপরি, ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সবে মাত্র ১৮ জুন অনুষ্ঠিত হয়েছে। হাসান রুহানির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ইব্রাহিম রাইসির। নতুন রাষ্ট্রপতি নেতৃত্ব একটি বড়সড় পরিবর্তন হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত আট বছর ইব্রাহিম প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেননি। 

রাইসি এমন একটা সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যখন ভিয়েনার যৌথ সমন্বিত পরিকল্পনা পুনর্জীবনের বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ডেসিপিও স্থগিত রেখেছিলেন। ২০১৮ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। আর সেই কারণেই জি৭ দেশগুলি পাশে দাঁড়াতে পারেনি। 

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বর্তমানের মূল বিষয়। নির্বাচনের ফলাফল ইরানের অভ্যন্তরীন গতিবেগের উপর আর মধ্যম অঞ্চলের আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব ফেলবে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি রয়েছে। 

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ইরানি পদ্ধতিতে একটি অভিভাবক পরিষদ রয়েছে- যেখানে ৬ ইসলামিক আইন বিশেষজ্ঞ থাকবে। থাকবেন এক সুপ্রিম লিডারও। এই কমিটির নেতা নির্বাচন করে। 

এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে যা প্রাসঙ্গিত তা হল বিল্পব বিরোধী রাস্তায় তাদের পথ খুঁজে পাওয়ার কারণে তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী নেতাদের ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে সিস্টেমটি নিশ্চিত করেছে যে অভিভাবক পরিষদ েক আর সর্বাধিক প্রত্যাশিত প্রার্থীর জন্য জায়গা রেখে প্রায় সকল মধ্যপন্থী প্রত্যাখান করেছিল। 


ইব্রাহিম রাইসি বিচারবিভাগের প্রধান। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রার্থী হিসেবে স্থান করে নিতে পেরেছেন। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার জন্যও প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিনের মতে রাইসিকে পশ্চিমের দেশগুলি পছন্দ করে না। ইরান-ইরাক যুদ্ধের শেষের দিনগুলিতে ১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক বন্দি আর জঙ্গিদের গণহত্যা, ইরানের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নাতীত নয়। কারণ প্রচুর মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শুধুমাত্র চিন প্রতিবছর সবথেকে বেশি নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেয়। 

রাইসির দৃষ্টিভঙ্গী পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে মেলে না। সেই কারণেই তাঁর অবস্থান খুব একটা সহজ হবে না। অন্যদিকে ইরানে আবারও ক্ষোভের আগুন ধীরে ধীরে বাড়ছে। জিসিপিও স্বাক্ষরের পরে যথন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল তখন একটি সংক্ষিপ্ত বিরতি দেওয়া হয়েছিল। ইরানের অর্থনীতি বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১২.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক অংশ ছাড়া ইরানের অর্থনীতি কী হতে পারে তা তারা বুঝতে পেরেছিল। 

ইরানে মুদ্রাস্ফীতির হার স্থানীয়দের কাছে বেদনাদায়ক। ২০১৭ সালে এটি ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। বেকারত্ব ১২ শতাংশের ওপরে। তার ওপর রয়েছে কোভিডের ফাঁড়া। আর সেসবকিছু কাটিয়ে উঠতে রাইসে নিষেধাজ্ঞা তোলার রাস্তা খুঁজছেন।

ইরানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করে শক্তিগুলি তার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির ওপর সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে এর থেকে আরও বেশি কিছু বের করতে চায়। যদিও রাশিয়া আর চিনের মধ্যপন্ধী ভূমিকা থাকবে। রাশিয়া আর চিন সমীকরণ দৃশ্যত শক্তিশালী  যদিও দুটি দেশের উদ্দেশ্যে এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ইন্দো প্যাসিফিকে মার্কিন আগ্রাসন রুখতে চায় উভয় দেশই। 

ইসরায়েলেল জেসিপিও এবং নিষেধাজ্ঞা যেভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন অন্যান্য জাতি। নতুন ইসরায়েল সরকার গছন করে গাজায় মারাত্মক সহিংসতা থেকে সতেজ হয়ে নতুন ইরান নেতার বিস্ফোরণ ধনানোর বাইরে আর কোথাও যাওয়ার আশা করা যায়না। উভয় পক্ষেই মন্ত্র হিসংবে হার্ডলাইন থাকায় ইরান আর ইসরায়েল যে এখনই সুর নরম করবে না তা স্পষ্ট নয়। এটি মধ্য প্রাচ্যের একটি জ্বলন্ত সমস্যায়। যার আন্তর্জাতিক পরিব্যাপ্তিও রয়েছে। 

আমেরিকা হাত গুটিয়ে নেবে- এই ব্যাপারে আমি এতটা নিশ্চিত নই । অনেকগুলি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেমকে নতুন করে নিয়োগ করার জন্য ক্ষতবিক্ষত করার সংবাদ পাওয়া গেছে। 

ইরান সম্পর্কে অভ্যন্তরীন ফ্যাক্টর হল আগ্রহ বাড়ানোর বিষয়। এখানে অস্থিরতা রয়েছে। তবে প্রকৃত তীব্রতা অনুমান করা যায়না। একাধিক নেতৃত্বের সক্ষমতাও বোঝা যায়নি। নিষেধাজ্ঞাসমূহ সজহ করার পরে যদি অর্থনীতিতে উন্নতি হয় তবে বিভিন্ন শব্দ ক্রমন্বয় হ্রাস পাবে। অস্বস্তিতে পড়তে বেশিরভাহ লোক রাগান্বিত হয় আর ভবিষ্যত প্রজন্ত এই দশা দেখতে চায়না। 

রাজনৈতিক আর্দশগত নেতৃত্ব যা ইরানের ক্ষেত্রে এক হয় গেছে। এটি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন আর তাই ভিয়েনার আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে শেষ করার আকাঙ্খা রয়েছে। ইরান কঠোর দরকাষাকষি করছে। তবে ইরান তার অর্থনৈতিক উন্নতিতে মরিয়া চেষ্টা করছে। 

ইসরায়েল আর ইরানের মধ্যে উত্তেজনা তৈরির জন্য সমস্ত বিষয়টির বিপর্যয়কারী কিছি বিভ্রান্তি রয়েছে। একটি সংযোগমুক্ত প্রচেষ্টা হতে পারে। উত্তেজনা বাড়লে দুই পক্ষেরই পিছনে ফিরে আসা কিছুটা কঠিন হবে। যা নিয়ে শক্তিশালী দেশগুলি রীতিমত উদ্বিগ্ন। 

তবে একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে যে কট্টরপন্থী রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও আপাতত ইরান অশান্তির পথে যাবে না। স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে। আপাতত পারমাণবিক অস্ত্রও প্রয়োগ করবে না। 

সবশেষে ভারত-ইরান সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটি কথা- ইরান আর পশ্চিমের দেশগুলি যখন কথা বলছে তখন ভারত-ইরান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পথ খোলা হয়েছে। আফগানিস্তান, দ্বালানি, চাবাহার, উত্তর-দিক্ষণ পরিবহন করিডোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী আবতাঠামো প্রকল্পগুলির নিষেধাজ্ঞার ফলে মূলত সহযোগিতাই হবে প্রধানলক্ষ্য। 

তারপরে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের পুরোপুরি ধারনা রয়েছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভারতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে, বিশেষত জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কিত। বিহত বহু বছর দুটি দেশই দ্বিধা সরিয়ে একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের মতই ইরানেই লক্ষ্য আর্থিক সমৃদ্ধি। তাই দুটি দেশ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির পথ প্রসস্ত করবে। তুলনায় কিছুটা হলেও পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। ভারতের উচিৎ এই মুহূর্তে তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। 

লেখকঃ জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইন (অবসরপ্রাপ্ত) ভারতীয় সেনার শ্রীনগর কর্পসএর প্রাক্তম কমান্ডার, তিনি কাশ্মীরের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। এই কলামটি ২০ জুন প্রথম চাণক্য ফোরামে প্রকাশিত হয়েছিল 

Share this article
click me!

Latest Videos

প্রেমের আড়ালে লক্ষাধিক টাকা লুঠ! প্রতারণার নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর কাহিনি | South 24 Parganas News Today
'যেসব মুসলমানরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন তাঁদেরই পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিল' বিস্ফোরক অর্জুন
West Bengal-এ জঙ্গিযোগ নিয়ে Mamata Banerjee-কে চরম তুলোধোনা Agnimitra Paul-এর! দেখুন কী বললেন
'তৃণমূলের দুয়ারে সরকার এখন দুয়ারে জঙ্গি', তীব্র আক্রমণ শুভেন্দু অধিকারীর | Suvendu Adhikari
চমকে উঠবেন! কৃষ্ণনগর পক্সো আদালতের বড় সাজা ঘোষণা | Nadia Latest News