সিকিউরিটি ব্যবস্থার দিক থেকে দেখলে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে সেই ভিডিও গুলো সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে বোঝা যায়, আক্রমণকারী কোনও ফ্যাকট্রিতে বানানো উন্নত গুণমান যুক্ত অস্ত্র ব্যবহার করেনি, বরং তার কাছে যা পাওয়া গেছে তা নেহাতই বাড়িতে বানানো দেশি হ্যান্ডগান যাকে বলা হয় ‘জিপ গান’। এর রেঞ্জ কম, মারণ ক্ষমতা আরো কম।
জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গত ৮ই জুলাই জাপানের নারা শহরে নিহত হয়েছেন। ৬৭ বছর বয়সী জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় এই নেতা রেল স্টেশনের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভোট প্রচারে এসে স্ট্রিট কর্নারে ভাষন দিচ্ছিলেন। সেই সময় তার পেছনে রাস্তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা আততায়ী ৪১ বছর বয়সী তেতসুয়া ইয়ামাগামি তাঁর উপরে গুলি চালায়।
যে কোনও রাষ্ট্রনায়কের ক্ষেত্রে এই ধরনের হামলা হতেই পারে। কিন্তু শিনজো আবের মতো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর উপরে এই ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর সিকিউরিটি সিস্টেমের উপরে বেশ কতগুলো জটিল প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। শিনজো এক রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা নেতা। তাঁর বাবা ছিলেন জাপানের বিদেশ মন্ত্রী, দাদু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং সিকিউরিটি থ্রেট কতটা এবং তা থেকে কি ভাবে সুরক্ষিত থাকতে হয় তা তাঁর বেশ ভালো ভাবেই জানা।
জাপানি পুলিশ আর সরকারি সিকিউরি্টি এজেন্সি একসাথে ইনভেস্টিগেশন চালাচ্ছে। তবে এর মধ্যেই কিভাবে আততায়ী তার দিকে সঠিক নিশানায় অল্প দূরত্বে এসে গুলি চালালো আর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তার ভিডিও অসংখ্য নিউজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
সিকিউরিটি ব্যবস্থার দিক থেকে দেখলে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে সেই ভিডিও গুলো সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে বোঝা যায়, আক্রমণকারী কোনও ফ্যাকট্রিতে বানানো উন্নত গুণমান যুক্ত অস্ত্র ব্যবহার করেনি, বরং তার কাছে যা পাওয়া গেছে তা নেহাতই বাড়িতে বানানো দেশি হ্যান্ডগান যাকে বলা হয় ‘জিপ গান’। এর রেঞ্জ কম, মারণ ক্ষমতা আরো কম।
শিনজো আবের এই প্রোগ্রামের সিডিউল একদিন আগেই ঠিক হয় আর তা সোশ্যাল মাধ্যমে জানানো হয়। ধরে নেওয়া যেতে পারে আততায়ী তার প্রস্তুতির জন্যে হাতে মাত্র এক দিন সময় পায়। এক দিনের মধ্যে এই প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়। তার মানে অনেক আগে থেকেই সে রেডি হচ্ছিল, বরং হঠাৎ করে সুযোগ এসে গেলে সে তার ব্যবহার করে।
জাপান এমনিতে বেশ শান্ত দেশ। তেমন কোন টেরর অর্গানাইজেশন সেখানে সক্রিয় নেই। এমনকি সেই দেশে রাষ্ট্রনেতাদের উপড়ে হামলার ইতিহাস খুব কম। জাপানে আগ্নেয়াস্ত্র রাখাও বেশ ঝামেলার। লাইসেন্স বিহীন অস্ত্র ধরা পরলে ১৫ বছরের জেল, যদি এরকম দুটো আগ্নেয়াস্ত্র এক জনের কাছে পাওয়া যায় তবে তার সাজা হবে ৩০ বছর। গান লাইসেন্স দেওয়া হয় খুব কম। যেটুকু বা দেওয়া হয় তা কেবল মাত্র এয়ার রাইফেল আর ১২ বোরের শটগান বা আমরা যাকে সাধারনত বন্দুক বলি তার। হ্যান্ডগানের লাইসেন্স দেওয়া হয় না, বা দিলেও খুবই সামান্য। অর্থাৎ দেশের আইন ব্যবস্থা যখন সাধারণ মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব নেয় তখন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার কোন প্রয়োজন হয় না। আমেরিকার ঠিক বিপরীত মেরুতে জাপানীদের চিন্তাধারা।
যে কোন হত্যার পেছনে দুটি মূল ফ্যাক্টর থাকে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে অস্ত্র, আর আরেকটা হচ্ছে উদ্দেশ্য। অস্ত্র পাওয়া গেলেও উদ্দেশ্য নিয়ে সিকিউরিটি এজেন্সি চিন্তিত। বন্দুকধারী আততায়ী কি উদ্দেশ্য নিয়ে এই আক্রমণ চালিয়েছে তা এখনো জানা যায়নি তবে শিনজো আবের মতো ব্যক্তিত্ব খুব একটা সাধারণ কারনে নিহত হবেননা এটাই স্বাভাবিক। একটানা ৮ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন জাপানের বৈদেশিক সম্পর্ক পরিবর্তনে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। একাধারে যেমন রাশিয়ার সাথে শান্তি চুক্তি করতে উদ্দত ছিলেন, তেমনি চীন আর উত্তর কোরিয়ার সাথেও সম্পর্ক শুধরাতে চেয়েছিলেন। আবার ওদিকে জাপানে ৫০০০০ আমেরিকান সেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মোতায়েন আছে, তাইওয়ানের সাথেও জাপানের সম্পর্ক ভালো। এই ব্যালান্স রাখতে গিয়ে কি কোথাও সমস্যা হচ্ছিল? তাহলে কি তাতে কোন বৈদেশিক শক্তির সমস্যা হচ্ছিল? এই প্রশ্ন উঠছে।
আর যে অস্ত্র পাওয়া গেছে বন্দুকবাজ আততায়ী এই অস্ত্র বানালো কিভাবে আর সেটা নিয়ে প্রটেক্টেড পার্সন বা সুরক্ষিত ব্যক্তির এত কাছে পৌঁছল কি করে সেটা সিকিউরিটি ফেলিওরের বড়ো উদাহরণ। ছবি দেখে মনে হচ্ছে এই অস্ত্র আমাদের দেশি পাইপ গানের উন্নত রূপ। এক্ষেত্রে দোনলা বন্দুকের ডিজাইনে দুটো পাইপ গানকে একসাথে একটা কাঠের কুঁদোতে বাঁধা হয়েছে। আর সেটাও আবার ডাক্ট টেপ দিয়ে। তবে এই হ্যান্ডগানের আসল তাক লাগানো ব্যপার হচ্ছে এতে একটা লিথিয়াম ব্যাটারি আর বৈদ্যুতিক তার লাগানো ছিল। সাধারনত এই ব্যাটারি আমরা ফোন বা ল্যাপটপে ব্যবহার করি। আততায়ী এই ব্যাটারি, কার্তুজের প্রাইমারি এক্সপ্লোসিভ বা ফিউজে আগুন লাগাতে ব্যবহার করেছে। এতে সুবিধে হচ্ছে ট্রিগারের সাথে মেকানিকাল হ্যামার বা ফায়ারিং পিন মেকানিজম লাগাতে হয়নি। স্রেফ একটা ছোট ইলেকট্রিকাল সুইচ দিয়েই কার্তুজ ফায়ার করেছে।
দেশি বন্দুক বানাতে লেদ মেসিন, লোহার পাইপ, কাঠ ইত্যাদি লাগে, কিন্তু এই ধরনের হ্যান্ডগান বানাতে বাড়িতে ব্যবহার্য জিনিসপত্রই যথেষ্ট। ফলে আততায়ী এই আগ্নেয়াস্ত্র জাপানের অস্ত্র আইনের চোখ বাঁচিয়ে বানাতে পেরেছে আর সেটা নিয়ে প্রাক্তন প্রধান্মন্ত্রীর কাছে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছে। এই ফাঁক সে দেশের সিকিউরিটি সিস্টেমের কাছে বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ!
অবশ্য এই ধরনের অস্ত্র দূরপাল্লার টার্গেটে খুব একটা কার্যকর হতে পারেনা। কিন্তু যে জায়গাতে অস্ত্র নিয়ে যাওয়া মানা, বা অস্ত্র যোগার করা মুস্কিল যেমন জেল, এয়ারপোর্ট, অনুষ্ঠান ভবন, সেক্ষেত্রে এই ধরনের অভিনব ব্যবস্থা শান্তিকামী মানুষের সুরক্ষাকে একটা বড় প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।
আততায়ী আক্রমণের ভিডিও খুব খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে হ্যান্ডগানের প্রথম গুলি শিনজো আবেকে মিস করে যায়। শব্দ এবং ধোঁয়া দেখা গেলেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তখন দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন, শব্দ শুনে তিনি তাঁর বাম দিকে ঘুরে তাকান, কিন্তু দ্বিতীয় গুলি তাকে ধরাশায়ী করে। দুটো ফায়ারের মধ্যে যে সময়ের গ্যাপ ছিল সেটা সিকিউরিটি ব্যবহার করতে পারেনি। ঐ সময়ের মধ্যে না কেউ আততায়ীকে ঠেকাতে পারে যাতে দ্বিতীয় ফায়ার না হয়, আবার ওদিকে টার্গেট শিনজো আবেকে বুলেট প্রুফ শিল্ড দিয়েও কেউ ঘিরতে পারেনি। যে শিল্ড একটা ফোল্ড করা ব্যাগের আকারে সিকিউরিটির কাছে থাকে। ভিডিওতে সেটা একজনের হাতে দেখাও গেছে। অন্তত পক্ষে কেউ একজন শিনজো আবেকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিলেও দ্বিতীয় গুলি টার্গেট মিস করত। যা অন্য অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। এই ধরনের সিকিউরিটি ব্যবস্থাতে প্রথম গুলি মিস করলে দ্বিতীয় গুলি টার্গেটে হিট করার চান্স আরো কমে যায়।
মেডিক্যাল রিপোর্ট বলছে দুটো গুলি তাঁর পিঠে লেগেছে। তার মানে আততায়ী শট গানের মতো কার্তুজ যাতে একাধিক পেলেট বা ছড়রা থাকে, সেই ধরনের কার্তুজ ব্যবহার করেছে। বিশ্বের সমস্ত সিকিউরিটি এজেন্সি, যারা এই ধরনের ভিআইপি সুরক্ষা দিয়ে থাকে, আগামী দিনে তাদের কাছে এই ঘটনা পুরো সিস্টেমকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
বিভাস রায় চৌধুরী -- প্রাক্তন বায়ুসেনা, বর্তমানে হলদিয়া পেট্রকেমিক্যাল কোম্পানির ফিজিক্যাল সিকিউরিটি আধিকারিক।
আরও পড়ুন- শিনজো অ্যাবের পর এবার সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী, ফেসবুক পেজে খুনের হুমকি দিয়ে আটক
আরও পড়ুন- জাপানের সবথেকে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, ঝকঝকে ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবন
আরও পড়ুন- ১ কেজি এই ফলের দাম ২০ লক্ষ টাকা! আরও জানলে অবাক হবেন