ইসলাম-কে আঘাত করা মানেই শিরচ্ছেদ, কেন বারবার এমন অসহিষ্ণুতা, আলোচনায় দেবর্ষি ভট্টাচার্য

বিশ্ব জুড়েই বেড়ে চলেছে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা
আর এর প্রতিফল ঘটছে বারবার সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে
এই ধর্মীয় সন্ত্রাসে সবচেয়ে বড় শিকার পশ্চিমের দেশগুলি
সম্প্রতি ফ্রান্সের এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখাল ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার রূপ

amartya lahiri | Published : Dec 3, 2020 8:50 AM IST / Updated: Dec 03 2020, 04:10 PM IST

দেবর্ষি ভট্টাচার্য, প্রতিবেদক----  আপাত দৃষ্টিতে একটি স্ফুলিঙ্গ যেন নিমেষে দাবানল হয়ে বিশ্বব্যাপী আছড়ে পড়লো। ইতিহাসের মাস্টারমশাই স্যামুয়েল প্যাটি ফ্রান্সের একটি ইস্কুলে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ বিষয়ক শিক্ষাদানের ক্লাসে ‘চার্লি হেডবো’ পত্রিকায় প্রকাশিত নবী মহম্মদের ব্যঙ্গচিত্রকে উদাহরণ হিসেবে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রদর্শন করেন। ক্লাসে উপস্থিত অনেকের মধ্যে ১৮ বছরের তরতাজা এক চেচনীয় কিশোর ছাত্র তাঁর ধর্মগুরুকে নিয়ে এইরকম ব্যঙ্গাত্মক চিত্র প্রদর্শনী মনেপ্রাণে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। পরদিন প্রকাশ্য রাস্তায় ওই চেচনীয় কিশোর ধারালো অস্ত্রে মাস্টারমশাই স্যামুয়েলের ধড় থেকে তাঁর মুণ্ডু ছিন্ন করে দেয়। অস্ত্র পরিত্যাগ করে ধরা দিতে অস্বীকার করায় রক্তাক্ত ঘটনাস্থল থেকে ৬০০ মিটার অদূরেই পুলিশ ওই চেচনীয় কিশোরকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। নবী মহম্মদের ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করার অভিযোগে বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের একটি বৃহৎ অংশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই ঘটনার পুনঃ প্রতিক্রিয়ায় এরপরেও ফ্রান্সে আরও কয়েকজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়।

এই একটি ঘটনা বাস্তবে দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পৃথক আঙ্গিক রেখে গেল, যা থেকে ভবিষ্যৎ শিক্ষা নিতে না পারলে পৃথিবীটা হয়তো একদিন মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। প্রথমত, যাকে মানুষ তাঁর আরাধ্য আসনে বসিয়ে মন-প্রাণ নিবেদন করে থাকে, তাঁকে নিয়ে কোন রকম চটুল ব্যঙ্গবিদ্রূপ সাধারণত কোন মানুষই অনুমোদন করে না। ধর্মপ্রাণ ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষজনের ক্ষেত্রে এই রীতি বেশ কঠোরভাবে অনুশীলন করা হয়ে থাকে। আর মত প্রকাশের স্বাধীনতারও একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা বিলক্ষণ আছে। যে মতের প্রকাশ ঘটলে অন্য কেউ ব্যথিত হয়, মনঃক্ষুণ্ণ হয়, অসন্তোষ ও অশান্তির আবহের সৃষ্টি হয়, সেই মত প্রকাশের ক্ষেত্রে লাগাম টানার নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদ সকল নাগরিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে, যা একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে মান্যতা পেয়েছে। আবার সেই ভারতীয় সংবিধানেরই ১৯(২) অনুচ্ছেদ মানুষের এই অধিকারে কিছুটা রাশও টেনেছে। যেমন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া, বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিঘ্নিত হওয়া, শালীনতা রক্ষা বা নৈতিকতা, জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারে সীমারেখা টানা হয়েছে। হতে পারে সংবিধান প্রণীত এইসকল সীমারেখা লক্ষ্যগত (Objective) দৃষ্টিকোণের চেয়ে বিষয়গত (Subjective) দৃষ্টিকোণের ওপর অধিকতর ভিত্তি করেই টানা হয়েছে, তবু নিশ্চিতভাবে রয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকারের সীমারেখা লক্ষ্যগত ভিত্তিতে চিহ্নিতকরণের প্রয়োজনীয়তা আজকের এই অস্থির পৃথিবীতে বোধহয় ভীষণভাবে জরুরী। যাই হোক, সুশৃঙ্খল সমাজজীবন অটুট রাখার লক্ষ্যে মানুষের মত প্রকাশের বা বাক স্বাধীনতা কখনোই অন্তহীন হতে পারে না। ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া ওই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফরাসী প্রেসিডেন্ট অবাধ মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিলেও, তা নিশ্চিতভাবে কখনোই অন্যের বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে না।  

এই ঘটনার অন্য আঙ্গিকটা হয়তো আজকের দিনে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ছোটবেলা থেকেই আমার মতো অনেকেই জেনে এসেছে, ধর্ম মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ, সহনশীল ও ধৈর্যশীল করে গড়ে তোলে। পৃথিবী নামক গ্রহের অসংখ্য মানুষদের শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজজীবনের গণ্ডীতে বেঁধে রাখার জন্য ধর্মের প্রয়াসই প্রাচীনকাল থেকে সর্বজনস্বীকৃত; আইনের অনুশাসন তো অনেক পরের সৃষ্টি।  কিন্তু বড় হতে হতে কি চাক্ষুষ করলাম আমরা? ধর্ম অনুসারীদের মধ্যে একটা বড় অংশই যে আদৌ ধর্মপ্রাণ হতে চাননি বা পারেননি; বরং তাঁরা প্রবলভাবে ধর্মান্ধই থেকে গিয়েছেন। টগবগে রক্তবাহক একটি কিশোর তাঁর মাস্টারমশাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যে নির্দয়তার নিদর্শন রেখে গেল, পৃথিবীব্যাপী সকল ধর্মালম্বী মানুষদেরই একযোগে তা নিন্দা করার কথা ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল যে, বয়স ও মনে পরিপক্ক মানুষেরাও নাক ঘুরিয়ে ওই নারকীয় ঘটনার সাফাই দিতে প্রস্তুত! সকল ধর্মের মূল ভিত্তি মানবতাকে বেমালুম অস্বীকার করেই! এই প্রশ্রয়ের ফল কতখানি মারাত্মক হতে পারে সেই দূরদর্শিতাকে ছাই চাপা দিয়েই! যে কোন ধর্মের গুরু স্থানীয় মানুষেরা যদি তাঁদের অনুসারীদের ধর্মপ্রাণ মনকে ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণুতার চাদরে আচ্ছাদিত করে দিতে অক্ষমই থেকে যান, তবে সমাজজীবনে মানুষ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীব হিসেবে আদৌ টিকে থাকতে পারবে তো! ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া ওই পৈশাচিক ঘটনার পরোক্ষ সমর্থনকারীদের কি একবারও মনে হয়েছিল, ইতিহাসের মাস্টারমশাই স্যামুয়েল প্যাটি একজন অতি তুচ্ছ মানুষ; আর নবী মহম্মদ বিশ্বপিতার আসনে সদা বিরাজমান, যিনি জগতময় শান্তির বানী প্রচার করে এসেছেন। একজন তুচ্ছ মানুষের সহস্র কোটি ব্যঙ্গ কি আদৌ টলাতে পারে বিশ্বপিতার কীর্তি! তাই স্যামুয়েলকে ক্ষমা যদি বা নাও করা যেত, তাঁর মৃত্যু উল্লাস কি আদৌ কাম্য ছিল!  
    
ব্যক্তিমত প্রকাশের স্বাধীনতা নিঃসন্দেহে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই মত কারও বিশ্বাসের স্বপক্ষে হতে পারে, অথবা বিপক্ষেও যেতে পারে। কারও শব্দবন্ধ বা নিদর্শন যদি অন্য কারও ব্যক্তিগত, জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মগত স্বাভিমানে আঘাত করে থাকে, তা নিয়ে অবশ্যই বিস্তর সমালোচনার পরিসর খোলা রয়েছে। এমন ঘটনার সোচ্চারে প্রতিবাদ হওয়াটাই ব্যাথিত মানুষজনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সেই বক্তা বা নিদর্শনকারীকে ব্যক্তিগতভাবে পীড়ন এবং হত্যার আয়োজন ও উল্লাসকে চরম অসহিষ্ণুতার নগ্ন প্রতিফলন ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে! কোন মত বা নিদর্শনের সাথে কারও যদি কোথাও মতবিরোধ থেকে থাকে, তার প্রতিবাদ করার জন্য তো গণতান্ত্রিক সভ্যসমাজে হরেক পন্থা রয়েছে। কিন্তু সে পথে না হেঁটে অসহিষ্ণুতা নির্ভর ব্যাক্তি হেনস্থা বা ব্যাক্তি হত্যাই যদি প্রতিবাদের একমাত্র সম্বল হয় এবং তা যদি সমাজসিদ্ধ হয়ে পড়ে, তখনই বুঝতে হবে যে ধর্মীয় মৌলবাদের হিংস্র অ্যানাকোণ্ডা ক্রমশই গ্রাস করে ফেলছে গণতান্ত্রিক খোলসে আচ্ছাদিত আমাদের সমগ্র সমাজজীবনকে। কারণ মৌলবাদ শুধু শিখে এবং লিখে এসেছে তাদের একছত্রবাদের অসহিষ্ণু ইতিহাসের পরম্পরা। যে মৌলবাদের প্রথম এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অন্য কোন মতবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং প্রতিহিংসাপরায়নতা। মৌলবাদের এই পরম্পরার ব্যাপ্তি কিন্তু পৃথিবীব্যাপী সকল ধর্মের মোড়কেই প্রায় সমানভাবে বিস্তৃত। 

নিরন্তর ঘাত-প্রতিঘাত, সমালোচনা-আত্মসমালোচনা, অনুভব-অভিজ্ঞতার পথ পাড়ি দিতে দিতে উন্মত্ত এই পৃথিবীটা হয়তো ঠিক একদিন শান্ত হবে। সুস্থ, কোমল এবং সুন্দরও হবে। কোন একদিন হয়তো সমগ্র মানবজাতি সর্বান্তকরণে সেই ধর্মীয় চেতনার রসে নিজেদের নিমজ্জিত রাখার ব্রতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উঠবে, যে ধর্মীয় অনুশীলন মানুষ মানুষের মধ্যেকার সকল বেড়াজাল উপড়ে ফেলে উদার মনস্ক, ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল, সহনশীল নতুন এক পৃথিবীর জন্ম দেবে। নিশ্চই কোন একদিন পৃথিবীব্যাপী সকল মন্দিরের মন্ত্রোচ্চারণ, সকল মসজিদের আজান, সকল গির্জার প্রার্থনা উপচে পড়বে শুধুমাত্র সমগ্র মানবজাতির মঙ্গল কামনায়।

(এই লেখায় যাবতীয় মতামত লেখক দেবর্ষি ভট্টাচার্যের, আমাদের এই বিভাগটি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার স্থল। এই প্রতিবেদনে কোনও তথ্যগত ভুল বা অন্যকোনও বিষয় বিতর্ক তৈরি করলে তার দায়ভার পুরোপুরি লেখকের। এর সঙ্গে এশিয়ানেট নিউজ বাংলার কোনও যোগ থাকবে না।) 

দেবর্ষি ভট্টাচার্য- পেশায় বঙ্গবাসী কলেজের বাণিজ্য শাখার বিভাগীয় প্রধান। কিন্তু, সমাজবিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখিতে প্রবল ঝোঁক এবং আগ্রহ রয়েছে তাঁর। সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি-র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটও তিনি।

Share this article
click me!