প্রথমে স্ত্রীকে খুন বেঙ্গালুরুর এক অভিজাত আবাসনে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতার উড়ান ধরে ফিরে আসা। আর কলকাতায় পৌঁছনোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে শাশুড়িকে গুলি করে খুন। পরে শ্বশুরবাড়ির ফ্ল্যাটেই নিজের মাথায় গুলি জামাই-এর। সোমবার রাতের এই ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে কলকাতায়।
জানা গিয়েছে, সোমবার সন্ধ্যায় ফুলবাগানের রামকৃষ্ণ সমাধি রোডে যান অমিত আগরওয়াল। বছর বিয়াল্লিশের অমিত পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। রামকৃষ্ণ সমাধি রোডে রামেশ্বরম অ্যাপার্টমেন্টের বি-টাওয়ারের তেতলায় অমিতের শ্বশুর সুভাষ ধান্দানিয়ার অ্যাপার্টমেন্ট। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শ্বশুরের ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়েছিলেন অমিত। শ্বশুর সুভাষ দরজা খুলে জামাইকে ভিতরে নিয়ে যান। এই ফ্ল্যাটে অমিতের শ্বশুর সুভাষ এবং শাশুড়ি ললিতা থাকেন।
ওই টাওয়ারের বাকি বাসিন্দাদের দাবি, অমিত ভিতরে যাওয়ার পর থেকেই প্রবল চিৎকার ভেসে আসছিল। অমিত রীতিমতো চিৎকার করে শ্বশুর সুভাষ ও শাশুড়ি ললিতার সঙ্গে ঝগড়া করছিলেন। দুই তরফের মধ্যে প্রবল উত্তেজিত কথা কাটাকাটিও শুনতে পাচ্ছিলেন পাশের অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা। এই অবস্থায় কিছু সময় পরেই সুভাষ ধান্দানিয়ার ফ্ল্যাটে গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। এরপরই নাকি সুভাষ ধান্দানিয়া দৌঁড়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে এসে মূল সদরের হ্যাসবোল্ট বাইরে থেকে টেনে দেন। বছর সাতষট্টির সুভাষ আরএক প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই ফুলবাগান থানায় ফোন করা হয়।
এরপর রাত ৮ নাগাদ পুলিশ রামেশ্বরম অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছয়। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ সুভাষের ফ্ল্যাটের দরজা খোলে পুলিশ। দেখা যায় মেঝেতে পড়ে রয়েছে বছর বাষট্টির ললিতা ধান্দানিয়ার নিথর দেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। ঘরের মধ্যেই বিছানার উপরে মেলে বছর বিয়াল্লিশের অমিতের নিথর শরীর। তাঁর মাথায় গুলির চিহ্ন ছিল। বিছানার একপাশে পড়েছিল একটি পিস্তল। ললিতা ধান্দানিয়ার শরীরেও মেলে গুলির ক্ষত।
সুভাষ ধান্দানিয়া জানান, অমিতের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মধ্যে তাঁরা জানতে পারেন যে তাঁদের একমাত্র মেয়ে বছর ছত্তিশের শিল্পীও বেঁচে নেই। অমিত বেঙ্গালুরুতে গিয়ে তাঁকেও খুন করে এসেছে। পরিবার সূত্রেই জানা যায় যে, অমিত ও শিল্পী-র বিয়ে হয়েছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু, সম্প্রতি স্বামী-স্ত্রী-র বনিবনা হচ্ছিল না। অমিতের মতো শিল্পীও একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। স্বামীর সঙ্গে সেপারেশনে ছিলেন শিল্পী। বছর দশেকের ছেলেকে নিয়ে তিনি বেঙ্গালুরুতে থাকতেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, লকডাউনের পর বিমান চলাচল শুরু হতেই বেঙ্গালুরু যাওয়ার ফন্দি আঁটেন অমিত। পরিকল্পনা মতো শুক্রবার বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন অমিত। সেখানে হোয়াইটফিল্ড রোডের মহাদেবপুরা-র ব্রিগেড মেট্রোপলিশে স্ত্রী শিল্পী-র ফ্ল্যাটে ওঠেন। শিল্পীর বাবা সুভাষের দাবি, সেখানেই তাঁদের মেয়েকে গুলি করে খুন করেন অমিত।
এরপর সোমবার সকালের বিমান ধরে কলকাতায় ফেরেন অমিত। সঙ্গে নিয়ে আসেন ১০ বছরের ছেলে। কলকাতায় পৌঁছেছেই আগে ছেলেকে ভাই-এর বাড়িতে রেখে এসেছিলেন অমিত। এরপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চড়াও হয়েছিলেন শ্বশুরবাড়িতে।
পুলিশ জানিয়েছে, সেপারেশনে থাকতে থাকতেই বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করেছিলেন শিল্পী। কিন্তু, কিছু সম্পত্তি নিয়ে শিল্পী-র সঙ্গে অমিতের বিবাদ চলছিল। অমিত চাইছিলেন শিল্পী যাতে ওই সম্পত্তিগুলি তাঁর নামে ট্রান্সফার করে দেন। এই নিয়েই স্বামী-স্ত্রীর-মধ্যে গত কয়েক বছর ধরেই ঝামেলা লেগেছিল। জানা গিয়েছে, শ্বশুরের বাড়িতে ঢুকে অমিত কিছু নথি বের করেন এবং তাতে শাশুড়ি ললিতা ধান্ধানিয়াকে সই করতে বলেন। এমনকী শ্বশুরের স্বাক্ষরেরও দাবি করেছিলেন কিছু নথি। কিন্তু, শ্বশুর-শাশুড়ি দুই জনেই সই করতে অস্বীকার করেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন অমিত।
পরে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার ক্রাইম মুরলীধর শর্মা জানান, বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশের কমিশনারের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। ব্রিগেড মেট্রোপলিশ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শিল্পীর পচাগলা দেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
বেঙ্গালুরু পুলিশ সূত্রে খবর, সোমবার দুপুর থেকেই ব্রিগেড মেট্রোপলিশে শিল্পীপ ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। কিন্তু, কেউ পুলিশে খবর দেননি। পরে কলকাতা পুলিশের কাছে থেকে অমিতের বেঙ্গালুরু আসা এবং স্ত্রী-কে খুন করার বিষয়টি জানার পর সেখানে বেঙ্গালুরু পুলিশ যায়। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বেঙ্গালুরু পুলিশ জানতে পেরেছে, অমিত মাঝেমধ্যেই শিল্পীর ফ্ল্যাটে আসতেন। কিন্তু, দুই জনের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। বেঙ্গালুরু পুলিশ শিল্পীর ফ্ল্যাটে-র দরজার বেশকিছু আঁচড়ের চিহ্ন পেয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে জোর করে কেউ ফ্ল্যাটের অটোমেটিক লকের হ্যান্ডেল সমানে ঘুরিয়ে গিয়েছিল। বেঙ্গালুরু পুলিশ সূত্রে আরও খবর যে, ঘরে ঢুকতেই দেখা গিয়েছে চারিদিকে জিনিসপত্র ছড়ানো-ছেটানো এবং ভেঙে পড়ে রয়েছে। মনে করা হচ্ছে এখানে শিল্পী-র সঙ্গে হাতাহাতি হয়েছিল অমিতের। এমনকী, শিল্পী হয়তো প্রথমে অমিতকে ফ্ল্যাটে ঢুকতেই দিতে চাননি। কারণ দরজার আচড়ে স্পষ্ট যে দরজায় দুজনের মধ্যে ভালোরকমের ধস্তাধস্তি হয়েছে। বেডরুমের কাছে একটি কোণে শিল্পীর গুলিবিদ্ধ দেহটা পড়েছিল।
কলকাতা পুলিশের সঙ্গে আপাতত যোগাযোগ রেখে চলেছে বেঙ্গালুরু পুলিশ। শিল্পীর দাদা-র বয়ানও নথিভুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দাদার বয়ান থেকেই এই হত্যাকাণ্ডে অনেককিছু প্রমাণ করা সম্ভব বলে মনে করছে কলকাতা পুলিশ।