তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানেই কলকাতার যাত্রী পরিবহণ ব্যবস্থায় আলোড়ন। হয় বাস ধর্মঘট না হয় ট্যাক্সি ধর্মঘট। হলুদ রঙের ট্যাক্সির সেই রমরমা যুগে সেই সময় লোকের মুখে মুখে বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের নাম। আর অবশ্যই এই ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের মূল চরিত্র বিমল গুহ। একেক সময় মনে হত বিমল গুহ-দের যা জনপ্রিয়তা বা লোক পরিচিতি তাতে রাজনীতির আঙিনায় কেন এনাদের দাপাদাপিটা বেশি করে দেখা যায় না।
কলকাতার বুকে ট্যাক্সি যাত্রী পরিবহণ আন্দোলনে এক বর্ণময় চরিত্র বিমল গুহ। একটা সময় খবরের শিরোনামে বিমল গুহ নামটা জ্বলজ্বলে করে থাকাটা বাঙালি তার নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছিল। নব্বই দশকের শুরুতে আস্তে আস্তে খবরের শিরোনামে আসা শুরু। যবে থেকে কলকাতার এক নামি সংবাদপত্র তাদের আলাদা করে কলকাতার পেজকে রঙিন করে তুলল সেদিন থেকে আরও বেশি করে বাঙলা ও বাঙালির রোজকার জীবনের একটা চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন বিমল গুহ।
তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানেই কলকাতার যাত্রী পরিবহণ ব্যবস্থায় আলোড়ন। হয় বাস ধর্মঘট না হয় ট্যাক্সি ধর্মঘট। হলুদ রঙের ট্যাক্সির সেই রমরমা যুগে সেই সময় লোকের মুখে মুখে বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের নাম। আর অবশ্যই এই ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের মূল চরিত্র বিমল গুহ। একেক সময় মনে হত বিমল গুহ-দের যা জনপ্রিয়তা বা লোক পরিচিতি তাতে রাজনীতির আঙিনায় কেন এনাদের দাপাদাপিটা বেশি করে দেখা যায় না। তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানেই তখনকার সময়ের মহাকরণে পরিবহণ মন্ত্রীর দফতরে দফায় দফায় বৈঠক বিমল গুহদের। আর প্রতিটি মিটিং-এর শেষেই বিমল গুহর হুঙ্কার। চারপাশে তাঁকে ঘিরে থাকা বিশাল দলবল। সকলের মুখে তখন বিমল গুহর কথার মিলে স্লোগান। আর কিছুক্ষণ পরেই বৈঠক থেকে বের হওয়া গলদঘর্ম অথবা ক্ষিপ্ত মেজাজের তৎকালীন পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী।
কলকাতা শহরের বুকে হলুদ ট্যাক্সির অ্যাম্বাসেডর আলাদা একটা ইতিহাস তৈরি করেছে। একটা সময় বিশ্বজুড়ে কলকাতার পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে হলুদ রঙের অ্যাম্বাসেডর একটা আইডেন্টিটি হয়ে উঠেছিল। হলুদ রঙা ট্যাক্সির চালকদের সঙ্গে যাত্রীদের খটাখটি, মারপিট- সবকিছুই সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে বিরাজ করত। আস্তে আস্তে মানুষের মনেও একটা ধারনা তৈরি হয়েছিল যে হলুদ ট্যাক্সির চালক মানেই কোনও দুষ্টু লোক। যিনি হেন কাজ নেই যে .করতে পারেন না। কিন্তু, দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি, যাত্রীর হাজার রকমের দুর্ব্যবহার সামলিয়ে হলুদ রঙা ট্যাক্সির চালকরাও যে রক্ত-মাংসের মানুষ তা দৃঢ়তার সঙ্গে লোক মানসে প্রতিষ্ঠা করার কাজে যে মানুষটার নাম সর্বাগ্রে আসতে বাধ্য তিনি হলেন বিমল গুহ। তাঁর কল্যাণে মানুষের সামনেও আসতে থাকে কীভাবে হলুদ রঙের ট্যাক্সির চালকরা মানবিকতার পরিচয় রেখে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সে দুর্গম ঝড়ৃঝঞ্জার রাতে কোনও অসহায় যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে ট্যাক্সি ব্যাকসিটে ফেলে যাওয়া দূর্মূল্য জিনিস ফেরত দেওয়া- এমনই সব খবর একটা সময় বিমল গুহদের মতো মানুষের জন্য সকলের সামনে এসেছে।
এমনকী, বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের নথিভুক্ত নয় এমন ট্যাক্সি-তে ফেলে যাওয়া দূর্মূল্য জিনিসও বিমল গুহদের কল্যাণে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীকালে সেই জিনিস পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আসল মালিকের কাছেও। ট্যাক্সি-তে প্রিন্টার মিটারের আমদানিতেও যথেষ্ট সওয়াল করেছিলেন বিমল গুহ। আসলে তিনি সারাজীবন চেষ্টা করে গিয়েছেন সাধারণ মানুষ ও ট্যাক্সি চালকদের মধ্যে বিভেদের ব্যবধানকে কমিয়ে আনতে। এর জন্য বছর ভর বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ লেগে থাকত। তাঁর বিশ্বাস ছিল এমন সব উদ্যোগে ট্যাক্সি চালকরা আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে পারবেন।
যতদিন সুভাষ চক্রবর্তী-র মতো রাজনীতিক রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী ছিলেন ততদিন উজ্জ্বল হয়েছিল বিমল গুহ-র মতো পরিবহণ নেতাদের নাম। তার নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলনে নূন্যচম ট্যাক্সি ভাড়ায় বৃদ্ধি আসে। কিন্তু, কখনই আবার অবান্তজর বৃদ্ধির কথা বলে সাধারণ মানুষের উপরে চাপ বাড়ানোতেই আপত্তি ছিল তাঁর। মধ্যবিত্ত বাঙালির ট্যাক্সি চড়ার স্বাদে বাড়়তি মাত্রা আনতে নানা ভাবে ট্যাক্সি-কে সাজিয়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে যেতেন। ট্যাক্সি চালকদের বোঝানোর চেষ্টা করতে ভ্যালু-ফর মানির কনসেপ্ট।
সম্প্রতি বিমল গুহরা দাবি করেছিলেন ট্যাক্সির ভাড়া প্রথম ২ কিলোমিটারের জন্য ৫০ টাকার করার দাবি জানান। এই মুহূর্তে ট্যাক্সিতে চড়লেই সর্বনিম্ন ভাড়া ৩০টাকা দিতে হয়। পেট্রল ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এই ভাড়া বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছিলেন বিমল গুহরা। এর জন্য ৪৮ ঘণ্টা ট্যাক্সি ধর্মঘটেরও ডাক দিয়েছিলেন তাঁরা। যদিও সেই ধর্মঘট হয়নি। পরে স্থগিত রাখা হয়।
রাজ্যে বাম জামানার অবসানে আস্তে আস্তে লাইম-লাইট থেকে হারিয়ে যায় বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন। তাদের অধিকাংশ ট্যাক্সি চালক মদন মিত্রদের সংগঠনে নাম লিখিয়ে ফেলে। প্রায় এক দশক ধরে সেভাবে আর শিরোনামে পাওয়া যেত না বিমল গুহকে। একটা একটা সময় মনে হত যারা রোজ হেডলাইন হয়ে থাকতেন আজ তারাই কেমন করে যেন কালো পর্দার পিছনে চলে গিয়েছেন। গত কয়েক বছর ধরেই প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বিমল গুহ। কর্কট রোগের ধাক্কা শরীরে কর্ম ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু, হার মানেননি বিমল গুহ। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আগলে ছিলেন তাঁর সাধের মোটর ট্রেনিং স্কুলকে। তিন দশকের যাত্রী পরিবহণ ব্যবস্থার এক সেলিব্রিটি ক্যারেক্টার হয়েও শেষযাত্রায় কার্যত আড়ালেই থেকে গেলেন বিমল গুহ। ৬ সেপ্টম্বর তাঁর ছেলে সুমন গুহ যখন ফেসবুকে বিমল গুহর প্রয়াণের খবর শেয়ার করেছিলেন তখন অনেকেই শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ৭৬ বছরে বিমল গুহ চলে গেলেন বটে, কিন্তু কলকাতা শহরে ওলা-উবারদের পূর্ববর্তী জামানায় যদু হলুদ রঙা ট্যাক্সির কথা খেয়াল পড়ে তাহলে নিশ্চিতভাবেই স্মরণে জায়গা করে নেবেন বিমল গুহ।