কলকাতার বুকেই ৩০০ মা-এর সন্তান তিনি, অসহায়ের মসিহা দেবকুমার

  • অসহায়-বিপন্ন জীবনের মাঝে ৩০০ মা-এর বড়ই আপন দেবকুমার
  • চোখ বন্ধ করলে আজও তিনি দেখতে পান অতিতের দিনগুলিকে
  • মনে মনে দেবকুমার শপথ করেছিলেন একদিন তিনি বড় হবেন 
  • কলকাতার রাস্তায়  দেবকুমার আজ সত্যিকারেই যেন এক দেবদূত
     

Ritam Talukder | Published : Oct 10, 2019 11:42 AM IST / Updated: Oct 10 2019, 11:52 PM IST

দেবকুমার মল্লিক। এক-দুজন নয়- একসঙ্গে ৩০০ মায়ের সন্তান তিনি। আর মা-য়েদের যাবতীয় প্রয়োজনের ঠিকানাও তিনি। এই মা-য়েদের কেউ বাস করেন রাস্তার ধারে, কেউ আবার ভাঙা-চোরা কোনও ঝুপড়িতে। বলতে গেলে এদের না আছে কোনও যথাযথ বাসস্থান, না আছে সঠিক ঠিকানা। কিন্তু, এঁদের সকলেরই একটা ঠিকানা বাধা আছে দেবকুমারের কাছে। কারণ, এই অসহায়-বিপন্ন জীবনের মাঝে ৩০০ মা-এর কাছে বড়ই আপন দেবকুমার। তাঁর দেওয়া অন্ন মুখেই তাঁরা আজও পেয়ে যান জীবনের আশার স্বপ্ন। রক্তহীন সম্পর্কেও এ যেন ৩০০ মা-এর এক চরম পাওয়া। কলকাতার রাস্তায় তাই আজ দেবকুমার সত্যিকারেই যেন এক দেবদূত। 

সফল ব্যবসায়ী। অর্থের প্রাচুর্য থাকলেও অহংকার কখনও বাসা বাধে না দেবকুমারের মনে। কারণ, চোখ বন্ধ করলে আজও তিনি দেখতে পান সেই অতিতের দিনগুলিকে। সেই সময় দেবকুমারের কাছে পৃথিবীটা রঙিন লাগলেও বাস্তবে তা ছিল বড়ই কর্কশ আর কষ্টে ভরা। বরাহনগরের বাড়িতে পক্ষাঘাতগ্রস্থ বাবা। মানসিক হাসপাতালে বড় ভাই। সংসারের বৈভবের ছোঁয়া থাকলেও তাতে তখন মরচে পড়েছে। সংসারের চাকা সচল রাখতে দেবকুমারের মা-র তখন এক অসম লড়াই। গৃহবধূ থেকে তখন তিনি গৃহশিক্ষিকার পেশা বেছে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে চলছে ফিজিওথেরাপিস্টের কাজ। 

ভোরের আলো ফোটার আগেই রান্না-বান্না করে ঘরের বাইরে পা রাখতেন দেবকুমারের মা। এরপর সারাদিন-এর নিরন্তর সংঘর্ষের পর তাঁর ঘরে ফিরে আসা। এরই মধ্যে মানসিক হাসচপাতালে গিয়ে বড় ছেলে-কে দেখেও আসতেন দেবকুমারের মা। এই লড়াই, বৈভবহীনতা, মা-এর অসমযুদ্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা-র সেবা সব-কিছুই অনুভব করতেন দেবকুমার। দাঁতে দাঁত চেপে সারাক্ষণ চেষ্টা করতেন নিজেকে সামালানোর। কলেজজীবনে ওয়েটার চাকরি নিয়েছিলেন সংসার চালাতে। সেখানে বেঁচে যাওয়া খাবার দেবকুমারকে দিয়ে দেওয়া হত। আর তা তিনি নিয়ে আসতেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ বাবা-কে খাওয়ানোর জন্য। কারণ, অর্থ দিয়ে রেস্তোরাঁর বাহারি খাবার কেনার মতো সামর্থ্য তাঁদের ছিল না। ভাগ্য বদলাতে একবার গুজরাটেও পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, হতাশ হয়ে ফের ফিরে আসা কলকাতার বুকে। মনে মনে দেবকুমার শপথ করেছিলেন একদিন তিনি বড় হবেন এবং সকল মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করার চেষ্টা করবেন। 

তাঁর এই ধারণা থেকেই আজ দুবেলা পেটপুরে খাবার পাচ্ছেন ৩০০ জন বৃদ্ধা মহিলা। এঁরা জানেন তাঁদের জন্য দেবকুমার রয়েছেন। শুধু খাবার নয়, যে কোনও ধরনের প্রয়োজনেই দেবকুমার রয়েছেন বলেই মনে করেন তাঁরা। মেডিক্যাল এমারজেন্সি হোক বা কোথাও ঘুরতে যাওয়া। শুধুমাত্র দেবকুমারকে একটা ফোন। তাহলেই হাজির হয়ে যাবেন তিনি। 

বাবা-মা ও তাঁরা দুই-ভাই নিয়ে মোট চারজনের সংসার ছিল দেবকুমারদের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিবার ছোট হয়েছে। প্রয়াত হয়েছেন দেবকুমারের বাবা। কিন্তু, এককালে যে কষ্ট দেবকুমার পেয়েছিলেন আজ ৩০০ বৃদ্ধার সেই কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করছেন তিনি।  সন্তানদের কাছে অবহেলিত এই বৃদ্ধারা এখন সন্তান-সম স্নেহে কাছে টেনে নিয়েছেন দেবকুমারকে। আসলে, বরাহনগরের চল্লিশোর্ধ্ব এই যুবক জানেন ছোট পরিবারকে কীভাবে বড় করতে হয়। তাই আজ একটু একটু করে বাড়ছে তাঁর পরিবার। ৩০০ মা-এর আশীর্বাদের হাত তাই তাঁর মাথার উপরে। কে তার পরিবারকে ছোট করবে! তাঁকে যে যেতে হবে এখনও অনেক দূর। 
 

Share this article
click me!