কাঁটাতারে মানবাধিকার, ২ থেকে ৩হাজার মহিলা ও শিশু জানখালাস হয়ে এখানে জেলে পচছে

  • ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে লঙ্ঘিত মানবাধিকার
  • অনুপ্রবেশকারীদের বেআইনিভাবে আটকে রাখার অভিযোগ
  • দু-থেকে তিনহাজার মহিলা-শিশু জেলবন্দি
  • মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও তারা দেশে ফিরতে পারছে না

Sabuj Calcutta | Published : Jan 8, 2020 1:07 PM IST / Updated: Jan 08 2020, 07:10 PM IST

ফেলানি খাতুনের মৃত্যু থেকে শুরু করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ, গরুপাচার আর কাঁটাতারে মানবাধিকার...।   মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সম্পাদক কিরীটি রায়ের সঙ্গে কথা বললেন সবুজ মুখোপাধ্যায়।

সবুজ- ফেলানি খাতুনের মৃত্যুর পর ন-বছর কেটে গেল। এখনও বিচার পেল না পরিবার। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কীভাবে দেখছেন বিষয়টাকে?
কিরীটি রায়- দেখুন, ন-বছর আগে সীমান্তে কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় কিশোরী ফেলানি। ২০১১-র জানুয়ারির ৭ তারিখে। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল তখন। তাই সীমান্ত থেকে আরও অনেকের মতোই দালালের মাধ্যমে এ-পার থেকে ও-পারে যাচ্ছিল। ওদের চল্লিশজনের দলটার মধ্যে ৩৯জন পার হয়ে গিয়েছিল। মই বেয়ে ওঠার সময়ে ওর সালোয়ার আটকে যায় কাঁটাতারে। তখন ওকে দেখতে পেয়ে গুলি চালান বিএসএফ জওয়ান অমিয় ঘোষ। কিন্তু বিএসএফের কোর্টের বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হন তিনি। পরে যখন আপিল আদালতে যাওয়া হয়, তখন ওর বাবা সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য দেন ওদের দেশের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্রাহাম লিঙ্কন। কিন্তু সেখানেও অবলীলাক্রমে ছাড় পেয়ে যান অভিযুক্ত জওয়ান।

সবুজ- শুনেছি আমাদের দেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানির পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিল?
কিরীটি রায়- হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। মানবাধিকার কমিশন স্পষ্ট জানিয়েছিল, একজন ওই বয়সের কিশোরী, যার পা আটকে গিয়েছে কাঁটাতারে, তার পক্ষে আর যাই হোক বিএসএফকে আক্রমণ করা সম্ভব নয় কোনওমতেই। এটি একটি ঠান্ডামাথায় খুন। তাই ওই ক্ষতিপূরণের নির্দেশ।

সবুজ-কিন্তু সেই নির্দেশ তো মানা হয়নি?
কিরীটি রায়-তা তো হয়নি। তা মানতে গেলে তো ঘুরিয়ে স্বীকার করে নিতে হয় যে বিএসএফ কোনও প্ররোচনা ছাড়াই গুলি চালিয়ে মেরেছিল ওই কিশোরীকে।

সবুজ-সেই সময়ে তো ছবিটা খুব তোলপাড় ফেলেছিল বিদেশে।
কিরীটি রায়-হ্যাঁ, ওইভাবে গুলি খেয়ে মাথা উল্টো করে কাঁটাতারে ঝুলে রয়েছে একজন কিশোরী... কী মর্মান্তিক! জানেন, চারঘণ্টা ওইভাবে ঝুলেছিল মেয়েটা। কিন্তু কেউ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। এমনকি মেয়েটা মরে যাওয়ার আগে একটু জল চেয়েছিল। সেটুকু পর্যন্ত তাকে দেওয়া হয়নি। বিএসএফের এই কীর্তি গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল। বাংলাদেশে সেই সময়ে লাখো-লাখো পোস্টার পড়েছিল। ওরা বলেছিল, কাঁটাতারে ফেলানি ঝুলছে না, বাংলাদেশ ঝুলছে।

সবুজ-শুনেছি, ফেলানিকাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিএসএফের গুলিতে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। 
কিরীটি রায়- তো বটেই। ফেলানি তো একটা দৃষ্টান্তমাত্র। আপনি জানেন কিনা জানি না, প্রতিবছর বিএসএফের গুলিতে অন্তত ১২০০জন নিহত হন। যাদের আশি            শতাংশই ভারতীয়! এই যে খবরে কাগজে বেরোয় না, গরু পাচার করতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে মৃত্যু। বা ধরুন ফেনসিডিল পাচারকারীর মৃত্যু। সবই কিন্তু 
এর মধ্যে পড়ে।

সবুজ- কিন্তু পাচারও তো এখন একটা বড় সমস্যা।  সেক্ষেত্রে বিএসএফকে তো কড়া হাতেই মোকাবিলা করতে হবে।
কিরীটি রায়- কড়া হোক না। কে বারণ করেছে? কিন্তু আইন মোতাবেক একজন বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর যা শাস্তি হওয়া উচিত তা হোক। গুলি করে মারা অধিকার তো তাদের কেউ দেয়নি। 

সবুজ-প্রসঙ্গত মনে পড়ল, এই যে সেদিন কর্নাটক থেকে কিছু লোককে ট্রেনে করে নিয়ে আসা হল হাওড়া স্টেশনে, তারপর তাদের পুশব্যাক করা হল...
কিরীটি রায়- শুনুন পুশব্যাক এখন রীতিমতো বেআইনি। এখানেও বিএসএফ আর রাজ্যপুলিশ একই কাজ করছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী, ওইভাবে পুশব্যাক করা যায় না। বেআইনি অনুপ্রবেশকারী কেউ ধরা পড়লে, তার বিরুদ্ধে কোনও ক্রিমিনাল কেস পর্যন্ত দেওয়া যায় না।

সবুজ- তাই নাকি?
কিরীটি রায়- হ্যাঁ, তাই। আপনাকে বলি তাহলে। সার্ক গোষ্ঠীর দেশগুলো ২০১০ সালে একটি সিদ্ধান্ত নেয়। আর তা হল, ভারত বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোতে কোনও দেশ থেকে কেউ যদি অন্য দেশে এসে পড়ে, পাচারের কারণে হোক কি অভাবেব কারণে, তাদের ওইভাবে পুশব্যাক তো করাই যায় না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনও ক্রিমিনাল কেস পর্যন্ত দেওয়া যায় না। তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করিয়ে কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে রাথতে হয়। তারপর নিয়মমাঠিক প্রত্যর্পণ করতে হয়। কিন্তু এখানে তো সেটা মানাই হয় না।

সবুজ- সেক্ষেত্রে তো গুলি চালানোর প্রশ্নই ওঠে না?
কিরীটি রায়- ওঠে তো না-ই। গুলি চালানো যেতে পারে দুটো ক্ষেত্রে, এক যদি বিএসএফ আক্রান্ত হয় তাহলে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে পারে তারা। আর যদি শত্রু আক্রমণ করে। নইলে গুলি চালানোর কোনও প্রশ্নই নেই। ফেলানির মতো নিরীহ কিশোরীই বলুন, কি গরু পাচারকারী, সবার ক্ষেত্রেই ওরা দেখায় যে ওরা আক্রান্ত হয়েছিল, তাই আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালিয়েছে।

সবুজ- আপনি বললেন, এখন পুশব্যাক করা যায় না, ওইভাবে জেলেও পোরা যায় না। কিন্তু বাস্তবে তো...
কিরীটি রায়- বাস্তবে তো এর ঠিক উল্টোটাই ঘটে। হয় পুশব্যাক করা হয়, নয়তো জেলে পোরা হয়। আর সেক্ষেত্রে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার ঘটে। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও স্রেফ প্রশাসনিক ঢিলেমির জন্য অনুপ্রবেশকারীদের জেলে পচতে হয়। চালু কথায় ওদের বলা হয় জানখালাস। দেখবেন দুই থেকে তিনহাজার মহিলা-শিশু এদেশে জানখালাস হয়ে জেলে পচছে। কী অমানবিক!

সবুজ- ফিরে আসি ফেলানি খাতুনের প্রসঙ্গে। ন-বছর হয়ে গেল, নিহতের পরিবার এখনও বিচার পেল না। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কি কিছু করার নেই?
কিরীটি রায়- দেখুন আমরা সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছি। ফেলানির বাবা নুর খান আর আমি দুজনেই স্বাক্ষর করেছি পিটিশনে। কিন্তু আদালতে এখনও অবধি মামলাটার শুনানি হল না। কী করতে পারি আমরা। ভারত যদি আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তর্ভুক্ত হত, তাহলে সেখানে গিয়ে বিচার চাইতে পারতাম আমরা। কিন্তু তা না-হওয়ায় আমরা অসহায়। এখন একমাত্র বাংলাদেশ সরাসরি মামলাটা আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যেতে পারে। এছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই।

Share this article
click me!