নব্বইয়ের দশক। শব্দদূষণ নিয়ে তখন কলকাতা হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। পুজোয় মাইক বাজানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, মসজিদে আজান বাজানোয় কোনও বাধা নেই, আর যত বাধা দুর্গাপুজোতেই। মসজিদে আজান নিয়ে কড়া হাতে রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ও খানিক থমকে গেলেন। সংখ্য়ালঘু অধ্য়ুষিত এলাকায় যদি দাঙ্গা লেগে যায়। অথচ এই রায় ছিল অত্য়ন্ত জরুরি। দ্বিধান্বিত হয়ে ভগবতীপ্রসাদ ফোন করলেন রাজ্য়ের মুখ্য়মন্ত্রী জ্য়োতি বসুকে। জ্য়োতি বসু শুনেই বললেন-- আপনি অর্ডার দিয়ে দিন, দরকার হলে মিলিটারি নামিয়ে দেব।
এই ছিলেন জ্য়োতি বসু। আজ তাঁর দশম মৃত্য়ুবার্ষিকী। দলের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও কীভাবে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন তিনি প্রশাসনের, তা পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে রয়েছে। ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থার পর ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে জনতা দলের সরকার। আর ওই বছরই পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্য়মন্ত্রী হন জ্য়োতি বসু। তারপর ২৩ বছর টানা তিনি রাজত্ব করেছেন, একেবারে দাপটের সঙ্গে। তাঁর টানা ৫বার মুখ্য়মন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড এখনও পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি এদেশে।
দলের মধ্য়েও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব না-থাকলেও সুভাষ চক্রবর্তী বনাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছায়াযুদ্ধ তাঁকে সামলাতে হয়েছে মাঝেমধ্য়েই। আর তা তিনি সামলেছেনও দারুণভাবে। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করার সাহস পায়নি কখনও। মনে আছে, রবীন্দ্রসরোবর লেক বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে তখন আন্দোলন চলছে। রাজ্য়ের মন্ত্রী তথা আরএসপি নেতা মতীশ রায়ও ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেন একদিন। তারপর একদিন মহাকরণে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, মতীশ রায় তো বলছেন... সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উত্তর-- দূর কে মতীশ।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এ রাজ্য়েও দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখন। প্রথমদিকটায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তিনি নিজেই নেমে পড়েন আসরে। সরাসরি চলে যান লালবাজারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে রাতারাতি।
বিতর্কও তাঁকে কম তাড়া করেনি। বৌবাজারকাণ্ডে রশিদ খান গ্রেফতার হলে তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে জ্য়োতি বসুর নাম। একই বিমানে দেখা গিয়েছিল জ্য়োতিবাবু আর রশিদকে। আর তাই নিয়ে খবরের কাগজে ধারাবাহিক লেখা। যার প্রেক্ষিতে সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে রাজ্য় সরকার। পরে অবশ্য় সেই মামলা তুলেও নেওয়া হয়। বানতলার ঘটনার পর জ্য়োতিবাবুর সেই মন্তব্য়ও কম বিতর্ক তৈরি করেনি। ওই সময়ে তিনি বলেছিলেন-- ওরকম তো কতই হয়। রাজারহাটে তাঁর আমলে জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল নিঃশব্দে। এর জন্য় কোথাও কোনও গুলি চলেনি। অন্য়দিকে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে এই জমি অধিগ্রহণ ইস্য়ুতেই জনপ্রিয়তা হারায় বামফ্রন্ট সরকার। ৩৪ বছরের বাম সরকারকে হঠিয়ে ক্ষমতায় আসে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের তৃণমূল কংগ্রেস।
জ্য়োতিবাবুর আমলেও গণ আন্দোলনে গুলি চলেছিল। ১৯৯৩ সালে ২১ জুলাই মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের নেতৃত্বে মহাকরণ অভিযানে গুলি চলেছিল। মারা গিয়েছিলেন ১৩জন। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গেসঙ্গে গুলি চলেছিল মরিচঝঁপিতেও। বাসভাড়া আন্দোলনে গুলি চলেছে একাধিকবার। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বিরোধী আন্দোলন জোট বাঁধতে পারেনি তাঁর আমলে। ২০০০ সালে তাঁকে সরিয়ে মুখ্য়মন্ত্রী পদে আনা হয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। প্রথমদিকে ব্র্য়ান্ডবুদ্ধ বলে হইচই করা হয় তাঁকে ঘিরে। জ্য়োতিবাবুর আমলে শিল্পে বিনিয়োগ হয়নি রাজ্য়ে এই দাবি তুলে বুদ্ধপন্থীরা জোর সমর্থন করলেন রাজ্য়ের নতুন মুখ্য়মন্ত্রীকে। কিন্তু তাতে করে কার্যত শেষের দিকে এগিয়ে চলল বামফ্রন্ট সরকার। সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে একদিন রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করলেন প্রাক্তন মুখ্য়মন্ত্রী জ্য়োতি বসু। এরপর এল নন্দীগ্রাম। গুলি চলল। অসুস্থ জ্য়োতিবাবু তখন বিধাননগরের বাড়িতে কার্যত একা। অনিল বিশ্বাসও মারা গিয়েছেন কয়েকবছর হল। জমি আন্দোলনের ধাক্কা সামলাতে না-পেরে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নিল।
মনে করা হয়, শেষ অবধি জ্য়োতিবাবুর মতো একজন বিচক্ষণ মানুষ যদি রাজ্য়ের ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে কিন্তু এভাবে বামসাম্রাজ্য়ের পতন হত না। শিক্ষাক্ষেত্রে অনিলায়ন থেকে শুরু করে হাজার-একটা সমস্য়া ছিল জ্য়োতি বসুর আমলে। কিন্তু কখনও পার্টিকে প্রশাসনের কাজে নাক গলাতে দেননি খুব একটা।