চিন ও ইরানের দোস্তি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বিশ্বশক্তির সমীকরণের ইজ্ঞিত, ভারতের থেকেও অস্বস্তিতে আমেরিকা

  • চলতি বছর একই সঙ্গে দুই ফ্রন্টে লড়াই শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র
  • একদিকে চিন আর অন্যদিকে ছিল ইরান
  •  বাণিজ্যযুদ্ধের নামে যেমন চিনকে একঘরে করার পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের
  •  তেমনি ইরানকেও কোণঠাসা করার পরিকল্পনা ছিল ট্রাম্পের
     

চলতি বছর একই সঙ্গে দুই ফ্রন্টে লড়াই শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে চিন, আর অন্যদিকে ছিল ইরান। বাণিজ্যযুদ্ধের নামে যেমন চিনকে একঘরে করার পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, তেমনি সেনাপ্রধান কাশেম সুলেমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইরানকেও কোণঠাসা করার পরিকল্পনা ছিল ট্রাম্পের। এখন সেই চিন ও ইরানে হাত মিলিয়েছে। আর তাতে ট্রাম্পের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়ছে!

যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু তোয়াক্কা না করে চিন এবং ইরান তাদের মধ্যে ২৫ বছরের একটি ‘কৌশলগত সহযোগিতার‘ চুক্তি নিয়ে বোঝাপড়া চূড়ান্ত করে ফেলেছে বলে জানা গেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইরানে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে চিন। জ্বালানি, বন্দর, সামরিক, তথ্যপ্রযুক্তিসহ ইরানের বিভিন্ন খাতে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে শি জিনপিংয়ের দেশ। এর বদলে চিন কম বিনিময় মূল্যে ২৫ বছর ধরে তেল ও গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ পেতে থাকবে ইরান থেকে।

Latest Videos

এই চুক্তিসংক্রান্ত ১৮ পৃষ্ঠার একটি নথি ইন্টারনেটের সম্প্রতি ফাঁস হয়ে গেছে। তাতে দেখা গেছে, ওই খসড়া প্রস্তাবটিতে জুন মাসের তারিখ উল্লেখ করা আছে। ইরানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর, এই খসড়া চুক্তির প্রস্তাবে এরই মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সম্মতি জানিয়েছেন। এখন চুক্তিটি অনুমোদনের জন্য ইরানের পার্লামেন্টে তোলা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তবে গত সপ্তাহে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ চুক্তির খসড়া তৈরির বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে চিনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

 

ওদিকে চিনের এই ব্যাপারে যদিও কিছুটা রাখঢাক আছে। গত সপ্তাহে চিনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ানকে এই  বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা। চুক্তির ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলেননি ঝাও। উল্টে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘চিন ও ইরানের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে মৈত্রী সম্পর্ক রয়েছে এবং দুই পক্ষ এখন পরস্পরের মধ্যকার দ্বিপাক্ষীক সম্পর্কের উন্নতির চেষ্টা চালাচ্ছে।’ চুক্তির গুঞ্জনকে উসকে দিয়ে ঝাও আরও বলেন, ‘বাস্তব সহযোগিতার দিকটি ক্রমান্বয়ে উন্নতি করতে আমরা ইরানের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত আছি।’

তবে চিন ও ইরানের মধ্যে এমন চুক্তি হলে সেটি বিশ্বের রাজনীতিতে নতুন এক মাত্রা এনে দেবে। শুরু হবে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার যাত্রা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এত দিন মনে করত, সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহী কে হাতে রাখার মাধ্যমে আরব বিশ্বে ছড়ি ঘোরানো সহজ হবে। এই ক্ষেত্রে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবও ছিল। কিন্তু চিন-ইরান দোস্তি হলে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন বিশ্বশক্তির পা পড়বে। এতে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য খাতের পাশাপাশি সামরিক বিষয়েও চিনের প্রভাব বাড়বে। ইরানের বন্দরগুলোতে যদি চিনা প্রভাব বৃদ্ধি পায়, তবে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবে।

 

কাশেম সুলেমানিকে হত্যার ঘটনা এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যকার পাল্টাপাল্টি হামলার পর থেকেই ইরানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আমেরিকা। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মূল ঝগড়ার শুরু আরও আগে। পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করার জন্য ইরানের সঙ্গে হওয়া চুক্তি থেকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে ফেলার পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ত তলানিতে এসে ঢেকেছে। এরপর ইরানের ওপর একে একে আসে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। চলতি বছরের শুরুর দিকে কাসেম সুলেমানির হত্যাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কথার লড়াই অস্ত্রের ঝনঝনানিতে রূপ নেয়। ইরানের ওপর আবার নেমে আসে নিষেধাজ্ঞার খড়্গ। এর কোপ থেকে এখনো বের হতে পারেনি ইরান।

ঠিক এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে  করোনাভাইরাস মহামারী। নানাবিধ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই করোনাভাইরাস মহামারীর জন্য ইরানের অর্থনীতির চাকা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে চিনের সঙ্গে চুক্তি ইরানের জন্য ‘জীবন রক্ষাকারী ওষুধে’র মতো। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চিনের সহযোগিতা পাওয়া ইরানের জন্য লাভজনক হবে। ইন্টারনেটে ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিতে দেখা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী চিন ও ইরানের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্যও আদান-প্রদান হতে পারে। আবার চিনা অস্ত্র ও প্রযুক্তি ইরানের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে ইরানের ওপর রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দেওয়া অস্ত্রবিষয়ক নিষেধাজ্ঞা। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ আছে এই নিষেধাজ্ঞার। ট্রাম্প প্রশাসন এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আর তাতে এরই মধ্যে বাদ সেধেছে চিন। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে শেষ পর্যন্ত না থাকার জন্য সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করেছেন রাষ্ট্রসংঘে নিযুক্ত চিনের প্রতিনিধি ঝ্যাং জুন। ইরানের ওপর অস্ত্রবিষয়ক নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর মার্কিন একটি প্রচেষ্টাও তখন ভেস্তে দিয়েছে চিন।

আরও পড়ুন: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু রাশিয়ায়, পুতিনের আকস্মিক নির্দেশে সামরিক মহড়ায় ৩ বাহিনী

চিনের সঙ্গে ইরানের এই চুক্তির মূল আলোচনা অবশ্য শুরু হয়েছিল সেই ২০১৬ সালে। তখন থেকেই ইরানকে বাগে আনার চেষ্টা চালাচ্ছিল চিন। করোনাকালে তা আশার আলো দেখেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো আলি আলফোনেহ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপের মুখেই এখন চিনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে ইরান। মূলত নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্যই এই পথ বেছে নিয়েছে হাসান রুহানির দেশ।

তবে চিনের এমনতর ‘সহযোগিতা’ অনেক ক্ষেত্রেই ‘গলার ফাঁস’ হতে পারে ইরানের। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে এর আগেও নানা দেশে বিনিয়োগের ঝুলি নিয়ে গেছে চিন। আর তাতে একসময় ঋণের ফাঁদেও আটকে পড়তে হয়েছে অনেক দেশকে। ইরানের ক্ষেত্রেও কি এমনটা হবে? উত্তর হলো, হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। ইরানের ভেতরে সরকারের সমালোচকেরা এরই মধ্যে এমন চুক্তির ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। দেশটির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ গত মাসে এ ব্যাপারে বলেছেন, ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির বিষয় ক্রমে জাতির চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলছে। প্রস্তাবিত চুক্তিটিকে ১৮২৮ সালে পারস্যের তৎকালীন শাসকের সঙ্গে জারের রাশিয়ার হওয়া চুক্তির অনুরূপ বলে তিনি মনে করেন। নিন্দুকেরা বলে থাকেন, ১৮২৮ সালের ওই চুক্তির কারণেই দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের ওপর পারস্য উপসাগরীয় এলাকার শাসকদের কর্তৃত্ব কমে গিয়েছিল।

আবার হাসান রুহানির সরকার দেশের ভেতরকার করোনা  পরিস্থিতিও খুব একটা ভালোভাবে সামাল দিতে পারছে না। অর্থনৈতিক ও কোভিড সংকটে ইরান কিছুটা দিশেহারা অবস্থায় আছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই  অবস্থায় চুক্তির খসড়া পার্লামেন্টে পাস করানো হাসান রুহানির জন্য কঠিন হতে পারে।

আরও পড়ুন: ফাঁস হলো জঙ্গিদের অমরনাথ তীর্থ যাত্রায় হামলার ছক, এর মাঝেই নির্বিঘ্নে পুজো দিলেন রাজনাথ

অবশ্য চিনের মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় নেই ইরানের। ওদিকে চিন ও ইরানের এই বন্ধুত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে মহা ফ্যাসাদে ফেলেছে। কারণ চিন-ইরান এক হওয়ার অর্থ হলো আরব বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যের দেয়ালে বড়সড় ফাটল দেখা দেওয়া। কেউ কেউ বলছেন, ইরানকে চিনের পাশ থেকে সরিয়ে আনার একটাই উপায় আছে। যদি ইরানের ওপর জারি করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত তুলে নেয়, একমাত্র তবেই হয়তো চিনের সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হতে পারে। তবে কে না জানে, কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার মিশন চালানোর পর ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে এমন সিদ্ধান্ত আসা সত্যিই বিস্ময়কর হবে। শেষ পর্যন্ত তেহরান ও বেইজিং এক হয়ে যায় কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদি এক হয়েই যায়, তবে তা যে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিকে নখদন্তহীন প্রমাণ করে ছাড়বে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

Share this article
click me!

Latest Videos

‘Bangladesh-কে মারতে হবে না চোখ দেখালেই যথেষ্ঠ’ বাংলাদেশকে ধুয়ে দিলেন Dilip Ghosh | Bangladesh News
Narendra Modi : 'কুয়েত যেন মিনি হিন্দুস্তান', কুয়েত সফরে এসে কেন বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী?
Suvendu Adhikari Live: এগরায় জনসভা শুভেন্দুর, কী বার্তা, দেখুন সরাসরি
Dev Adhikari : এবার কী আসছে খাদান ২? খাদান সাফল্য পেতেই বড়সড় ঘোষণা দেব-যীশুদের
'একটা আস্ত অশিক্ষিত...গোটা রাজ্যটাই জঙ্গিদের হাতে' কড়া বার্তা শুভেন্দুর | Suvendu Adhikari