সাইবার দস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অধিকাংশ দেশের সরকারই ব্যর্থ। তাই এদের সমুচিত শিক্ষা দিতে একটি বিশেষ পরিকল্পনা নেন মার্ক রোবার ও তাঁর বন্ধুরা।
মার্কিন মুলুক থেকে বসেই কলকাতায় থাকা তিন কল সেন্টারকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিলেন এক ইউটিউবার এবং তাঁর দল। অভিযোগ, কলকাতার সল্টলেক এলাকায় থাকা এই তিন কল সেন্টার আসলে একটি সাইবার অপরাধের কারখানা। যারা দিনের পর দিন মার্কিন মুলুকে অসংখ্য মানুষের অর্থ সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ডাকাতি করছে। এই সাইবার দস্যুরা গত এক বছরে অন্তত ৬০ লক্ষ মার্কিনির কাছ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার লুঠ করেছে বলে অভিযোগ ইউটিউবার মার্ক রোবারের।
এই সাইবার দস্যুদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন মার্ক রোবার। সোমবার তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে ২৬ মিনিটের এই সাইবার অপারেশনের স্টিং ভিডিও আপোলড করেছেন মার্ক। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে কলকাতার সল্টলেক থেকে চলা ৩টি বৃহৎকারের আন্তর্জাতিক কল সেন্টার এবং দিল্লির একটি কল সেন্টার দিনের পর দিন মার্কিনিদের অর্থ তচ্ছরূপ করে নিজেদের অ্যাকাউন্ট ভরছে।
মার্ক রোবারের দাবি, এই সাইবার দস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অধিকাংশ দেশের সরকারই ব্যর্থ। তাই এদের সমুচিত শিক্ষা দিতে একটি বিশেষ পরিকল্পনা নেন মার্ক রোবার ও তাঁর বন্ধুরা। সম্প্রতি কলকাতার এবং দিল্লির এই কল সেন্টারগুলো অনলাইনে বেশ কয়েক জন মার্কিনির কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। এদের মধ্যে একজন ছিলেন অবসারপ্রাপ্ত এক বৃদ্ধা। যিনি ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। কলকাতার সল্টলেক থেকে চলা এই কল সেন্টারের একটি ওই মহিলার কাছ থেকে ২০ হাজার মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেয়।
মার্ক রোবার তাঁর এই ভিডিও-তে কলকাতা এবং দিল্লির এই চার কল সেন্টারের নাম ও পরিচয় তুলে ধরেছেন। তবে, আইনিগত কিছু জটিলতায় দিল্লির কল সেন্টারের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করেনন মার্ক। তিনি দেখিয়েছেন, কলকাতার এই তিন কল সেন্টারের নাম- মেট টেকনোলজি। যার ঠিকানা হল নিউ টাউনের ইকোস্পেস, ব্লক ৩এ, প্লট নম্বর- আইআইএফ বাই ১১ এএ, আইআই, নিউটাউন। এর ডিরেক্টর হিসাবে মার্ক উল্লেখ করেছেন কুণাল এবং কিশোর কুমার গুপ্তা-র নাম। এরা কল সেন্টার ব্যবসায় ১১ বছর ৯ মাস ১১ দিন ধরে রয়েছে বলেও দাবি করেছেন মার্ক। তিনি জানিয়েছেন, এই কল সেন্টার থেকে আমেরিকায় বসবাসকারীদের কাছে অ্যামাজন প্রাইম বা ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা অথবা ডিজনি থেকে ফোন করছি বলে কল যায়। আর এখান থেকে শুরু হয় প্রতারণার ফাঁদ।
ভিএমআর বলে আরও একটি কল সেন্টারের নাম করেছেন মার্ক। যার ঠিকানা সল্টলেকের গোদরেজ জেনেসিস বিল্ডিং, ১২০৩ সল্টলেক, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ। এর ডিরেক্টর হিসাবে রাজেশ এবং বিদ্যা গোয়েঙ্কার নাম করেছেন মার্ক। অভিযোগ, এই কল সেন্টার থেকে অ্যামাজন প্রাইম, মাইক্রোসফট এবং ট্যাক্স রিটার্ন-এর নাম আমেরিকায় বসবাসকারীদের কাছে কল যায়। আর সেখান থেকেই শুরু হয় প্রতারণা।
এরপর কলকাতার সল্টলেকের যে তৃতীয় কল সেন্টারের নামটি মার্ক নিয়েছেন, তা হল অংশ টেকনোলজি। এর ঠিকানা ৩৫, ইএন ব্লক, সেক্টর ফাইভ, বিধাননগর। এর ডিরেক্টর অলকেশ এবং ভগবাম বিয়ানি। ১০ বছর ৮ মাস ৯ দিন ধরে কল সেন্টার ব্যবসায় রয়েছে অংশ। এরাও অ্যামাজন প্রাইম, উইন্ডোজ এবং আইআরএস-এর নাম করে আমেরিকানদের ফোন করে তাঁদের অর্থ হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ।
মার্ক তাঁর ভিডিও-তে দেখিয়েছেন, তাদের একটি দল সম্প্রতি কলকাতায় আসে। এরা এই তিন কল সেন্টারের সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে। এমনকী এই তিন কল সেন্টারে তাঁদের লোকজনকে কাজে লাগায়। এর জন্য কলকাতার বুকে কিছু বিশ্বস্ত যুবকে তাঁরা এই অভিযানে সামিল করে। এরা মার্কদের হয়ে এই কল সেন্টারগুলোতে কাজ নেয়। আর সময় বুঝে মার্কদের ট্রিকস এই তিন কল সেন্টারে প্রয়োগ করে। যাকে সোজা ভাষায় বলা হয় প্যাঙ্ক। আর এই প্যাঙ্কের মাধ্যমে তারা এই তিন কল সেন্টারের অফিসরুমকে এক্কেবারে নাস্তানাবুদ করে দেন। যে ভিডিও দেখে এখন হাসতে হাসতে পেট চাপা দিচ্ছেন নেটিজেনরা।
মার্কদের টিম কলকাতায় পা রাখার আগেই আমেরিকা থেকে এই তিন কল সেন্টারের সিসিটিভি হ্যাক করেছিল। আর সিসিটিভি-র মাধ্যমে তাঁরা এই চার কল সেন্টারের সিস্টেমে ঢোকার পাস ওয়ার্ড সব ট্রেস করে নিয়েছিল। যার ফলে হ্যাকিং-এর মাধ্যমে এই চার কল সেন্টারের সিস্টেমও হ্যাক করে ফেলে মার্ক এবং তাঁর দল। কলকাতায় এসে মার্কের টিম কয়েক শ আরশোলা সংগ্রহ করে। এর সঙ্গে কিছু ইঁদুরও কেনে তারা। এছাড়াও এমন একটি কেমিক্যাল যুক্ত সাবান বানায় যা হাতে দিলে রঙ বের হতে থাকবে এবং চিট চিট করবে। হাজার চেষ্টা করলেও তা ধুয়ো তোলা যাবে না। এই কেমিক্যাল যুক্ত সাবানের গায়ে একটি কভার লাগানো হয়। যার নাম দেওয়া হয় ভায়াগ্রা। আর এই প্যাকেটের গায়ে সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টরের নাম লিখে দেওয়া হয়।
এরপর এই সাবানকে ওই কল সেন্টারগুলোর বাথরুমে রেখে আসে মার্কের লোকেরা। এছাড়াও আরশোলাগুলোকে একটা বক্সের মধ্যে পুড়ে তা একটি টিফিন বাক্সের ব্যাগে ভরে নেয় মার্কের লোকজন। এরপর কল সেন্টারের ভিতরে থাকা মার্কের লোকেরা এই ব্যাগগুলোকে অফিসের ডেস্কে রেখে মুখ খুলে দেয়। কিছুক্ষণ পরে এই বক্স থেকে আরোশালার দল বেরিয়ে সারা অফিসে ছড়িয়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে অফিসের ডেক্সে একটি স্মোক বম্বও রেখে এসেছিল মার্কের লোকেরা। কিছুক্ষণ পর সেলফ টাইমার ফিট করা ওই স্মোক বম্ব থেকে সমানে দুর্গন্ধযুক্ত ধোয়া বের হতে থাকে। ধোয়ার দুর্গন্ধে অফিস ছেড়ে পালিয়ে যায় লোকজন। এখানেই শেষ নয়, অফিসের সিকিউরিটি টেবিলে কুরিয়ার মারফত একটি বিশাল বক্স এসে পৌঁছয়। সেই বক্স খুলতেই ফাটতে শুরু করে গ্লিটার বম্ব। আতঙ্কে লোকজনের অবস্থা তখন খারাপ। এই এই ট্রিকস মার্কের আর একটি দল দিল্লিতে অভিযুক্ত কল সেন্টারের অফিসে করে।
এরপর চমকের আরও দরকার ছিল। মার্কদের পাতা ফাঁদে ধরা দেয় কল সেন্টারের এক কর্মী। তিনি নাম ও পরিচয় বদলে ক্যারোলিনা নামে আমেরিকায় ফোন করেছিলেন। কিন্তু ফোন গিয়েছিল মার্কের হ্যাকিং টিমের কাছে। সিসিটিভি হ্যাক পুরো ঘটনা আমেরিকা থেকেই দেখছিলেন মার্করা। ওই কলসেন্টার কর্মীর ফোন মার্কের টিমের এক সদস্যের কাছে যেতেই তিনি ক্যারোলিনার আসল নাম এবং আর কোন নামে তিনি লোককে প্রতারণা করেন সেই সব নামও বলে দেন। এতেই চমকে যায় কল সেন্টারের লোকজন। চাঞ্চল্য ছড়ায়। এদিকে, কল সেন্টারগুলোর ডেটা বেস হ্যাক করে মার্কের লোকেরা কয়েক লক্ষ মানুষের বিস্তারিত তথ্য বের করে,যা ওই কল সেন্টারগুলো প্রতারণার কাজে ব্যবহার করত।
মার্ক জানিয়েছেন, তাদের এই স্টিং অপারেশনের পরে এখন ওই সব কল সেন্টারের কল আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দিল্লি একটি কল সেন্টার এবং কলকাতার ৩ কল সেন্টার বন্ধও রয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্ক। এদিকে, মার্কের দল কলকাতার তিন কল সেন্টারের বিরুদ্ধে লালবাজারে অভিযোগ দায়ের করেছে। এমনকী এই আন্তর্জাতিক সাইবার দস্যুদের সম্পর্কে যে তথ্য তাঁরা পেয়েছে তা এফবিআই এবং সিবিআই-এর হাতে তুলে দেবেন বলেও জানিয়েছেন মার্ক।
আরও পড়ুন- একের পর এক জঙ্গি নিকেশ কাশ্মীরে, অনন্তনাগের পর কুলগামে খতম দুই লস্কর সদস্য
আরও পড়ুন- মাদার টেরেসাকে নিয়ে নয়া বিতর্ক? এক অন্ধকার পথের সন্ধান দিচ্ছে নতুন ডকুমেন্টারি
আরও পড়ুন- অশনি থেকে আমফান-এক এক নামের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ওডিশা-বাংলা, কীভাবে নাম রাখা হয় ঝড়ের?