শামিকা মাইতি: মোট আট দফায় ভোট হচ্ছে বাংলায়। তার মধ্যে মাত্র চার দফা মিটতে না মিটতেই বিজেপির আসনে ‘সেঞ্চুরি’ হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভোটের ফল বেরোলে বোঝা যাবে সেই দাবির সারবত্তা কতটা। আপাতত, সদ্য শেষ হওয়া চতুর্থ দফার ভোটে কোন কোন আসনে অনুকূল অবস্থায় রয়েছে, তা নিয়ে জোরকদমে হিসাব শুরু করে দিয়েছে বিজেপি।
আরও পড়ুন-'ভাইপোকে কোথা থেকে কোথায় তুলে এনেছেন', মমতার বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ কতটা সত্যি...
১০ এপ্রিল মোট ৪৪টি আসনে ভোট হয়েছে। যার মধ্যে ১৪টি আসন উত্তরবঙ্গের কোচবিহার (৯টি) ও জলপাইগুড়ি (৫টি) জেলায়। বাকিগুলি দক্ষিণবঙ্গের হাওড়া (৯), হুগলি (১০) ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার (১১) মধ্যে পড়ে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে এই ৪৪টি আসনের মধ্যে ৩৯টিই তৃণমূলের দখলে এসেছিল। সিপিআই (এম) জিতেছিল ২টি আসনে। বিজেপি, কংগ্রেস আর ফরওয়ার্ড ব্লক একটা করে আসন পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে এখানে রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তৃণমূল ‘লিড’ পেয়েছে ২৫টি আসনে। উল্টোদিকে, বিজেপি তার শক্তি বাড়িয়ে ১৯টি আসনে ‘লিডে’ ছিল।
তৃণমূলের সমর্থন কমে গেল কেন?
রাজনীতির কারবারিদের মদতে, তৃণমূলের অপশাসন আর স্থানীয় নেতাদের দুর্নীতিতে তিতবিরক্ত এলাকার মানুষ। তারা পরিবর্তন চাইছে। সেই পালেই হাওয়া লেগেছে বিজেপির। মমতাও সেটা বুঝেছেন বলে এই সব আসনগুলির অধিকাংশতে প্রার্থী বদলে দিয়েছেন। যাতে সাধারণ মানুষের ক্ষমতাসীনের উপরে রাগ কিছুটা কমে। চতুর্থ দফায় কোচবিহারে যে ৯টি আসনে ভোট হচ্ছে তার মধ্যে ৭টিতে গত লোকসভা ভোটে এগিয়েছিল বিজেপি। এর মধ্যে ৬টিতে এবার প্রার্থী বদলে দিয়েছেন মমতা। একই ভাবে জলপাইগুড়ির সদ্য ভোট হওয়া ৫টি আসনের মধ্যে ৪টিতে প্রার্থী বদলিয়েছে তৃণমূল। লোকসভা ভোটের হিসাবে ৫টির ৫টিতেই এগিয়েছিল বিজেপি।
দক্ষিণবঙ্গে অবশ্য ছবিটা আলাদা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার যে ১১টা আসনে ভোট হয়েছে চতুর্থ দফায়, সেখানের সব ক’টিতেই লোকসভা ভোটেও এগিয়েছিল তৃণমূল। তারপরেও ওই ১১টি আসনের মধ্যে ৫টিতে নতুন প্রার্থী দিয়েছে তৃণমূল। হাওড়াতে যে ৯টা আসনে ভোট হয়েছে তার মধ্যে ৮টিতে লোকসভা ভোটে এগিয়েছিল তৃণমূল। মমতা এই আটটি আসনের মধ্যে ৭টিতে প্রার্থী বদলেছেন। হুগলির ভোট হওয়া ১০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৪টি আসনে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এগিয়েছিল। মমতা ৫টা আসনে প্রার্থী বদল করেছেন। সব মিলিয়ে যে ৪৪টা আসনে ভোট হল ১০ এপ্রিল, তার ২৭টিতে প্রার্থী বদল করে ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি এফেক্টে' প্রলেপ দিতে চেয়েছেন মমতা।কিন্তু শুধুমাত্র প্রার্থীর মুখ বদলে কি শাসকবিরোধী হাওয়ার গতিপথ বদলানো যায়?
গত দশ বছরে সারদা-রোজভ্যালির টাকা লুঠ থেকে শুরু করে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হজম, এমনকী গরিবদের রেশনের চালও তৃণমূলের লোকেরা চুরি করেছে। তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট-রাজের দাপটে কোনও কাজ করা দায়। ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকতে না ঢুকতে চাঁদার আবদার নিয়ে ঘরে চলে আসেন পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা। বার্ধক্য ভাতার টাকা থেকে সরিয়ে রাখতে হয় কাটমানি। গত বছর আমফানের ত্রাণের টাকা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির স্মৃতি এখনও তাজা। এদিকে, গত দশ বছরে শিল্পায়ণ স্তব্ধ বাংলায়। নতুন কল-কারখানা হয়নি। উল্টে বন্ধ হয়ে গিয়েছে হাজারে হাজারে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ প্রায়। কাজের খোঁজে ভিটেমাটি ছেড়ে ভিন্রাজ্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের। এই অবস্থায় রাজ্যে সামগ্রিক ভাবে তৃণমূলের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। ‘আসল পরিবর্তন’ চাইছেন সাধারণ মানুষ। প্রার্থী বদল করে ভোটারদের সেই ভাবনা কতটা প্রভাবিত করা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে রাজনীতির কারবারিদের।
তৃণমূলের অপশাসন, দুর্নীতি আর তোষণনীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার চালিয়ে ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি’ হাওয়াটা ধরে রাখছে বিজেপি। পাশাপাশি আসনভিত্তিক আলাদা-আলাদা স্ট্র্যাটেজি কষেছে তারা। প্রথমেই এই ৪৪টি আসনে জাতপাতের হিসাব করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে এই ৪৪টি আসনের মধ্যে মোটামুটি ভাবে ২০ শতাংশ মুসলিম, তফসিলি জাতি ২৪ শতাংশ আর উপজাতি ৪ শতাংশ। ১৮টি আসনে ২০ শতাংশেরও বেশি মুসলিম ভোটার রয়েছে। এই আসনগুলিতে মেরুকরণের রাজনীতি করে হিন্দুভোটকে এককাট্টা করার চেষ্টা করেছে বিজেপি। ২টো আসনে রাজবংশী ভোটার রয়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। রাজবংশী ভোটকে এককাট্টা করে এই দু’টি আসনে জিততে মরীয়া বিজেপি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই এলাকায় ভোটপ্রচারে এসে তাই ঘোষণা করে গিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীতে রাজবংশীদের জন্য আলাদা করে নারায়ণী ব্যাটেলিয়ন গড়ে তোলা হবে। আসামে রাজবংশীদের নেতা অনন্ত মহারাজের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতও করে এসেছেন অমিত। আর দিনহাটাতে রাজবংশী নিশীথ প্রামাণিককে প্রার্থী করা হয়েছে ফের। উল্লেখ্য নিশীথবাবু এই এলাকার বিজেপির সাংসদ। চা বাগানের শ্রমিকদের উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট এককাট্টা করার চেষ্টা হয়েছে আরও দু’টি আসনে।
দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির আলাদা স্ট্র্যাটেজি। এখানে মুসলিম ভোটের উপরে বিজেপির নিজের বিশেষ ভরসা নেই। তবে আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট বেশ কিছু আসনে ভোটের ফল ঘুরিয়ে দেবে বলে মনে করছে তারা। বস্তুত এই দফার ভোটে বেশ কিছু আসনে বাম-কংগ্রেস - আইএসএফ জোটের সংযুক্ত মোর্চা ওজনদার প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল যাদবপুরে সুজন চক্রবর্তী, ভাঙ্গরে আব্বাস সিদ্দিকির ভাই মহম্মদ নৌশাদ সিদ্দিকি, আলিপুরদুয়ারে কংগ্রেস নেতা দেবপ্রসাদ রায়, কসবায় শতরূপ ঘোষ, বালিতে দীপ্সিতা ধর, চাঁপদানিতে আবদুল মান্নান ও চণ্ডীতলায় মহম্মদ সেলিম। বিজেপিরও কিছু ওজনদার প্রার্থীর ভাগ্য পরীক্ষা হয়ে গেল এই দফার ভোটে। এর মধ্যে ডোমজুড়ে রাজীব ব্যানার্জ্জী, চুঁচুড়ায় লকেট চ্যাটার্জ্জীর উপরে বাজি ধরেই আছে বিজেপি।
টালিগঞ্জে বিজেপির প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়র প্রতিপক্ষ তৃণমূলের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। যাদবপুরে সিপিআই (এম) থেকে দলবদলে আসা রিঙ্কু নস্করকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। রিঙ্কু ২০১৪-এর লোকসভা ভোটে বামেদের প্রার্থী হয়েছিলেন যাদবপুর কেন্দ্রে। সেবার হেরে গেলেও ২০১৫ তে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ভোটে রিঙ্কু জেতেন। ২০২১-এ বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে বিজেপিতে যোগ দেন রিঙ্কু। যাদবপুর কেন্দ্রে বামেদের বহু দিন ধরেই জনভিত্তি রয়েছে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে ভোটের সমীকরণ ঘেঁটে দিতে রিঙ্কুকে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে বিজেপি। সব মিলিয়ে বলা যায়, হুগলি হাওড়া ও কোচবিহারে বিজেপি আর তৃণমূলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও জলপাইগুড়িতে তৃণমূলের পাল্লা তুলনায় ভারী বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।