শমিকা মাইতিঃ ২০১১ সালের শূন্য আসন থেকে ২০২১-এ মসনদ দখলের স্বপ্ন- পশ্চিমবঙ্গে এক দশকে যেন এক ছায়াপথ দূরত্ব অতিক্রম করল বিজেপি। কোন যাদুবলে সম্ভব হল এই উত্থান? ৩৪ বছর ধরে বাম রাজনীতিকে সমর্থন করে আসা বাঙালিরা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিজেপি-র মতো দক্ষিণপন্থী দলের দিকে ঝুঁকে পড়ল কী ভাবে? এ কি তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্যারিশমা? না বিজেপির মেরুকরণের হিন্দুত্ববাদ? রাজনীতির কারবারিদের মতে, এ’সব তো আছেই, তবে, সবার উপরে রয়েছে বাংলার মানুষের ‘আসল পরিবর্তনে’র ইচ্ছা। তৃণমূল সরকারের অপশাসন, তোষণ আর দুর্নীতিতে তিতবিরক্ত বাংলার মানুষ। শিল্প থেকে সংস্কৃতি সমস্ত দিকে বাংলার দ্বার যেন রুদ্ধ। এই অচলাবস্থা কাটাতে সর্বভারতীয় দল বিজেপির উপরে বাজি রাখা ছাড়া আর কোনও পথ নেই বাংলার মানুষের কাছে।
কারণ, এই মুহূর্তে বাকি দুই বিরোধী দল কংগ্রেস ও বামেরা নখদন্তহীন শার্দূলে পরিণত হয়েছে। এক ঝাঁক যুবনেতৃত্ব উঠে আসায় সম্প্রতি বামশিবির কিছুটা অক্সিজেন পেলেও গ্রামবাংলায় তাদের জনভিত্তি প্রায় বিলুপ্ত। কোনও এক অজানা কারণে বামনেতারা এখনও ‘আন্ডার গ্রাউন্ড' হয়ে রয়েছেন প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে। বাম সমর্থনের চোরাস্রোত থাকলেও নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ নেই। তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে ক’জন লড়াই জারি রেখেছেন, তাঁরা রাজনৈতিক ঢাল পেতে বিজেপিতে চলে গিয়েছেন অনেক আগে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির ৪০.৬৪ শতাংশ ভোটের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট এসেছিল বামদল থেকে আর ৭ শতাংশ কংগ্রেস থেকে। হিন্দু ভোটের হিসাব ধরলে এই সুইং আরও বেশি। লোকনীতি সিএসডিএস ডাটা অনুযায়ী, ২০১৯-এর ভোটে বিজেপি ৫৭ শতাংশ হিন্দু ভোট পেয়েছিল। যেখানে ২০১৪ সালে তারা পেয়েছিল ২১ শতাংশ। বামেদের ক্ষেত্রে হিন্দু ভোট ২০২৪ সালে যেখানে ২৯ শতাংশ ছিল, ২০১৯-এ কমে হয় ৬ শতাংশ। কংগ্রেসের ক্ষেত্রে ৬ থেকে কমে ৩ শতাংশ।
অর্থাৎ বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতিও কাজ করেছে পুরোদমে। মমতা ব্যানার্জীর হিজাব পড়ে ইফতার পার্টি বা ইমাম ভাতা সামগ্রিক ভাবে মুসলিমদের অবস্থার কোনও উন্নতি করতে পারেনি। মাঝখান থেকে হিন্দুদের কাছ থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এই মেরুকরণটা আরও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। রায়গঞ্জের মতো আসন যেখানে প্রায় ৪৯ শতাংশ মুসলিম ভোটার রয়েছে, সেখানেও এই হিন্দু ভোট এককাট্টা হওয়ার জন্য আসন জিতে বেরিয়ে গিয়েছে বিজেপি। এই আসনে মুসলিম ভোট ভাগ হয়েছিল তৃণমূলের কানাইয়ালাল আগরওয়াল ও সিপিএমের সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মধ্যে। কিন্তু হিন্দুভোটের পুরোটাই পেয়ে জিতে গিয়েছেন বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী। একই ভাবে কোচবিহার আসনে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটার থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের পরেশচন্দ্র অধিকারীকে ৫৪ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক। ২০১৪ সালে এই আসনে যেখানে বিজেপির ভোটশেয়ার ছিল ২৮ শতাংশ, ২০১৯-এ বেড়ে হয় ৪৮ শতাংশ। বালুরঘাটের ক্ষেত্রেও এক ছবি। এক তৃতীয়াংশ মুসলিম ভোট থাকা সত্ত্বেও এই আসনে তৃণমূলের বুদ্ধিজীবী নেত্রী অর্পিতা ঘোষকে ১৩ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন বিজেপির সুকান্ত মজুমদার।
বাংলায় বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির পিছনে রয়েছে আরএসএস-এর শক্ত হাত। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ জানিয়েছেন সংগঠনকে জোরালো করতে বাংলাকে ৫টা জোনে ভাগ করা হয়েছে। এরপর লোকসভা কেন্দ্র ধরে সাংগঠনিক জেলা কমিটিগুলোকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এর পরের ভাগ হল মণ্ডল কমিটি। আগে একএকটা মণ্ডল কমিটি যেখানে ২১০-২৭০টা বুথের দেখভাল করত, সেটা কমিয়ে ৬০-৯০ করা হয়েছে। যাতে আরও ভাল ভাবে বুথগুলোর কাজ পর্যালোচনা করা যায়। দিলীপ ঘোষ জানিয়েছেন, ৫-৭টা বুথকমিটি নিয়ে গঠন করা হয়েছে শক্তিকেন্দ্র। এগুলোর দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বলে বিস্তারক। এই পদে মূলত আরএসএস-এর স্বয়ংসেবকদের নিয়োগ করা হয়েছে। এই ভাবে বিজেপির সাংগঠনিক ভিত হিসাবে কাজ করছে আরএসএস। কিন্তু বাংলায় আরএসএস তো অনেকদিন ধরে রয়েছে। তাহলে বিজেপির এতদিন সময় লাগল কেন? রাজনীতির কারবারিদের মতে, এখানেই ঘুরেফিরে সেই শাসকদলের উপরে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বিষয়টি উঠে আসছে।
সারদা-রোজভ্যালির টাকা লুঠ থেকে শুরু করে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হজম, এমনকী গরিবদের রেশনের চালও তৃণমূলের লোকেরা চুরি করেছে। তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট-রাজের দাপটে কোনও কাজ করা দায়। ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকতে না ঢুকতে চাঁদার আবদার নিয়ে ঘরে চলে আসেন পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা। বার্ধক্য ভাতার টাকা থেকে সরিয়ে রাখতে হয় কাটমানি। গত বছর আমফানের ত্রাণের টাকা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির স্মৃতি এখনও তাজা। এদিকে, গত দশ বছরে শিল্পায়ণ স্তব্ধ বাংলায়। নতুন কল-কারখানা হয়নি। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ প্রায়। কাজের খোঁজে ভিটেমাটি ছেড়ে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের। লোকজন মনে করছে, কেন্দ্রে আর বাংলায় যদি একই দলের সরকার হয়, তাহলে হয়তো উন্নয়নের পালে হাওয়া লাগবে। নতুন কল-কারখানা তৈরি হবে। বাড়ির ছেলে বাড়িতে ফিরতে পারবে। শিল্প-সংস্কৃতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সোনার বাংলা।