বাংলার ভোটে এবার খুব শোনা যাচ্ছে মীরজাফর। দলবদলু নেতাদের এই নামেই ডাকছে তৃণমূল। এতে কেমন লাগছে সত্যিকারের মীর জাফরের পরিবারে? তাঁরা কিন্তু, বরাবরই তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক।
সভার পর সভায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় এবং তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের মুখে শোনা যাচ্ছে 'মীরজাফর' আক্রমণ। শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশ ত্রিবেদী বা মুকুল রায়দের মতো তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতাদের এই নামেই ডাকছে ঘাসফুল শিবির। বলছে বিশ্বাসঘাতক। এতে ভোটের ময়দানে তাদের কতটা লাভ হবে, তা ২ মে জানা যাবে। তবে অন্তত বাংলার একটি পরিবার যে তাঁদের ভোট দেবে না, তা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে - খোদ মীরজাফরের পরিবার।
সৈয়দ রেজা আলী মির্জার বয়স এখন ৮৫। চশমা ছাড়া দেখতে পান না বললেই চলে। মীরজাফরের এই বংশধর বেশি পরিচিত ছোটে নবাব নামে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর তিনি ও তাঁর সন্তান ফাহিম যারপরনাই ক্ষুব্ধ। ফাহিম আবার একজন সক্রিয় তৃণমূল কর্মীও বটে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা'র সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক মীরজাফরের বংশধররা জানিয়েছেন, তাঁরা বরাবর তৃণমূল কংগ্রেসকেই সমর্থন করেছেন। কিন্তু, আর কখনও ঘাসফুল শিবিরকে ভোট দেবেন না তাঁরা। কারণ ইংরেজ মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ইতিহাসকে বিকৃত করছেন।
তৈল চিত্রে মীরজাফর
প্রচলিত ইতিহাস বলে, ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সিরাজ-উদ-দৌল্লার মধ্যে যে পলাশির যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধে বাংলার নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মীর জাফর। তিনি সেনাদের ঠিকভাবে পরিচালনা না করাতেই সিরাজ-উদ-দৌল্লার হাতে ৫০,০০০ এরও বেশি সেনা থাকা সত্ত্বেও, মাত্র ৩,০০০ সেনা নিয়ে নবাব বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সিরাজকে শীঘ্রই বন্দী করে হত্যা করা হয়েছিল। আর তাঁর পর ব্রিটিশ ভারতে তাঁদের পুতুল নবাব হয়েছিলেন মীর জাফর। সেই থেকেই বাংলায় বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক হয়ে উঠেছে মীরজাফরের নাম।
মীর জাফরের বংশধররা অবশ্য এই কাহিনিকে ইতিহাস না বলে ইতিহাসের বিকৃতি বলেই দাবি করেন। মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারি থেকে সামান্য দূরেই পুরোনো, ম্লান, একটি নীলরঙা বাড়িতে থাকেন তাঁরা। ছোটে নবাবের পুত্র ফাহিম একটি কম্পিউটার স্টোর চালান। সেই রোজগারেই চলে পুরো পরিবারের। তাঁদের অভিযোগ, ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরাই মীর জাফরকে বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় দিয়েছিল। এই ইতিহাস ব্রিটিশদের রচিত, সত্য ঘটনা নয়। ছোটে নবাবের যুক্তি, মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক হলে, তাঁদের পরিবারকে নবাব নগরীতে থাকতেই দেওয়া হতো না। ফাহিম বলেছেন, তাঁদের পরিবার থেকে কেউ কোনওদিন নবাবি দিনগুলি নিয়ে কোনও বই লেখেননি। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের বিকৃত ইতিহাস সংশোধনে তিনি নিজেই কলম ধরার পরিকল্পনা করেছেন ফাহিম।
তবে, তাঁরা সথেকে বেশি ধাক্কা খেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যেই। মর্মাহত ছোটে নবাব বলছেন, মমতার জন্য তাঁদের পরিবারের অবদানকে স্বীকৃতি জানানো হয়নি। তিনিও অন্যদের মতোই ব্রিটিশদের ইতিহাসকেই মান্যতা দিচ্ছেন। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যকা পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়েছেন। কিন্তু, তাঁরা বাংলাকে ভালোবেসে এখানেই থেকে গিয়েছেন। তার বিনিময়ে এটাই কি তাঁদের প্রাপ্য় ছিল? প্রশ্ন তুলছেন তিনি। নবাব পরিবার এই অবস্থায় মনে করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ততা তৃমমূল কংগ্রেস তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তাই এতদিন ঘাসফুলে ভোট দিলেও এবার অন্য কথা চিন্তা করছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন - সিঙ্গুরের ভোটই বোঝাচ্ছে এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের বিপদ আছে
আরও পড়ুন - 'ভাইপোকে কোথা থেকে কোথায় তুলে এনেছেন', মমতার বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ কতটা সত্যি
আরও পড়ুন - কাকে ভোট দেবেন, কোন 'বন্ধু' মমতার প্রিয়তম - ধন্দে পাহাড়ের তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা
মুর্শিদাবাদ জেলায় মোট ২২ টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। ২৬ ও ২৯ এপ্রিল - অর্থার একেবারে শেষ দুই দফায় ভোটগ্রহণ হবে এই জেলায়। এখানকার মুসলিম জনসংখ্যা ৬৯ শতাংশেরও বেশি। তৃণমূলের আশা মেরুকরণের ফলে প্রথম চার দফায় তাদের যে ভোট কাটা গিয়েছে, তা মুর্শিদাবাদ থেকে তুলে নেওয়া যাবে। তবে, এই জেলা কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীর গড়। পাশাপাশি, আসাদউদ্দীন ওয়াইসির এইআইমিম এবং আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফকেও ভোটের কাঁটা মনে করছে তারা। বিজেপি এই জেলায় ৮ জন মুসলিম প্রার্থীকে ময়দানে নামিয়েছে। অন্যান্য জায়গায় তাদের নির্বাচনী মন্ত্র মেরুকরণ হলেও, একানে তাদের বার্তা 'সবকা বিশ্বাস'। তবে, তাঁদের পুঁজি বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরাই।