গত লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গ তৃণমূলকে নিরাশ করেছিল। সেই উত্তরবঙ্গ পুনরুদ্ধারের জন্য তৃণমূল নেত্রী দলকে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন। তা পূরণের পথে প্রশাসনিক গাফিলতি যাতে কোনও রকম বাধা হয়ে না দাঁড়ায় মুখ্যমন্ত্রী তা নিশ্চিত করতে চান বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিধানসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ এবং পরিকল্পনাও গুছিয়ে নিতে চাইছেন। যে সব উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ চলছে বা যেগুলি ঘোষিত হয়েছে, সেগুলি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করে ফেলতে হবে- সব জেলাকে মুখ্যমন্ত্রী এমন নির্দেশ দিয়েছেন বলেই নবান্ন সূত্রের খবর।
একুশের নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের জমি পুনরুদ্ধারই তৃণমূলের কাছে পাখির চোখ। উত্তরবঙ্গে দলের শোচনীয় পরাজয়ের পিছনে জেলাগুলিতে নেতৃত্বের অনৈক্য ছিল একটা বড় কারণ। তাই এবার উত্তরবঙ্গের ব্লক সভাপতিদের তালিকা প্রকাশ করার আগে নেতাদের মত নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাই উত্তরবঙ্গের ব্লক সভাপতিদের তালিকা প্রকাশের আগে নেতাদের নিয়ে বৈঠক হয়।
আরও পড়ুন-করোনা আবহে দ্বিতীয়বার, এবার জঙ্গলমহল সফরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়
বৈঠকে উত্তরবঙ্গের জেলা নেতাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত লোকসভায় তৃণমূলের লোকবল থাকা সত্বেও মানুষের কাছে তাঁরা পৌঁছতে পারেনি। সেই অবস্থার কি আজ উন্নতি হয়েছে?
রাজ্যে বাম-কংগ্রেস জোট হলে, ভোট কাটার অঙ্কে তারা অনেক কেন্দ্রে নির্ণায়ক হয়ে উঠবে। উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের হাতে গোনা কয়েকটি আসন ছাড়া জেতার মতো শক্তি এই মুহূর্তে তাদের নেই বললেই চলে। উত্তরবঙ্গে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই সরাসরি তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে। ভোটের এখনও কয়েকমাস দেরি। এর মধ্যে বদলে যেতে পারে অনেক কিছু।
তবে উত্তরবঙ্গের তৃণমূলের বহু পুরোনো নেতাদের বক্তব্য তৃণমূলের কয়েকজন নেতা ও বিধায়ক গত ১০ বছরে দলের যা ক্ষতি করেছেন তা বাম আর বিজেপি মিলে ২০ বছরেও করতে পারেনি। সেই নেতারা আগামী ভোটে উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি আসন বিজেপিকে উপহার দিতে পারেন।
এমনিতেই গোটা উত্তরবঙ্গে অন্তত দু-তিনটি জেলায় ভোটারদের বিন্যাস অন্য সব জেলার থেকে আলাদা। কারণ এখানে সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছে। তার একটা বড় অংশই বাম-কংগ্রেসের একান্ত অনুগত। একতা বড় অংশ আছে রাজবংশী ভোটার। ভোটের ফলাফল নির্ণয়ে তাদের একটা ভূমিকা থকে। এছাড়া উত্তরবঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চা বাগানের ভোট- যার অনেকটাই আদিবাসী ভোটব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল।
আরও পড়ুন-'গায়ের রং কালো',পণ না মেলায় বধূকে 'খুনের পর পুকুরে দেহ লুকিয়ে' রাখল পরিবার
চা-বাগানগুলিতেও আদিবাসীদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। চা শ্রমিকদের বড় অংশ জাতিগতভাবে নেপালি হওয়ায় তাঁদের ভোট এতদিন তৃণমূলে কমই পড়েছে। পাহাড়ের মোর্চা নেতা বিমল গুরুংয়ের প্রভাব এখনও এঁদের মধ্যে অনেকটাই। এই পরিস্থিতিতে গত দুটো লোকসভা ভোটে এই ভোটব্যাংকের সুফল বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে। কিন্তু বিমল গুরুং রাজ্যের সঙ্গে সন্ধির পথে এলে হিসেবনিকেশ অনেকটাই বদলে যাবে। জাতিবিন্যাসের অঙ্ক ছেড়ে উন্নয়নের প্রশ্ন সামনে এলে তৃণমূলের ঝুলিতে আরও কিছু ভোট জুটবে।
পৃথক জেলা ঘোষণার পর থেকে আলিপুরদুয়ারের জন্য তৃণমূল নেত্রী অনেক কিছু করেছেন। আলিপুরদুয়ার শহরে উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় প্রশাসনিক সদর দপ্তর ডুয়ার্সকন্যা হয়েছে। ফালাকাটার কৃষক বাজার রাজ্যে অন্যতম সেরা। ফালাকাটার সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল, স্টেডিয়াম বা হাটখোলার মার্কেট কমপ্লেক্স, জেলাজুড়ে ঝাঁ চকচকে রাস্তা। তবু আলিপুরদুয়ার নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। প্রথমত, দশরথ তিরকি আর জেমস কুজুরের জমানায় এই বিধানসভা এলাকায় একটা স্কুলের একটা পাঁচিলও বিধায়ক কোটার টাকায় হয়নি। অথচ বছরে ৬০ লক্ষ টাকা পান এই বিধায়করা। সেই হিসাবে ১০ বছরে ৬ কোটি টাকায় এঁরা কী করেছেন? আলিপুরদুয়ার পুরসভায় ক্ষমতায় থেকেও শহরে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প তো দূরের কথা, একটা ডাম্পিং গ্রাউন্ড করতে গিয়ে নাকানিচোবানি খেয়েছে তৃণমূলের বোর্ড।
জলপাইগুড়ি জেলাতেও তৃণমূলের অবস্থা ভাল নয়। উনিশের ভোটে তাদের পায়ের তলার মাটি অনেকটাই সরে যায়। তার উপর গত কয়েক মাস ধরে জলপাইগুড়ি জেলার তৃণমূল জেলা সভাপতি ও প্রাক্তন সভাপতির লড়াই এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে জেলায় তৃণমূলের মধ্যেই দুটি দল সমান্তরাল ভাবে চলছে।
আরও পড়ুন-'আপনার বয়েস হয়েছে-ভুলে যাওয়ার রোগ ধরেছে', মমতাকে খোঁচা অগ্নিমিত্রার
আসন্ন ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে জেলায় জেলায় একতার বার্তা দিয়েছিলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর সেই আবেদন শিকেয় তুলে সমানে চলছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দলের অন্দরেই বিভাজন রেখা স্পষ্ট, একই দলের মধ্যে চলছে দুটি দল। তৃণমূলের এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীরা বাজিমাত করার চেষ্টা করবে। আবার এমনও হতে পারে তৃণমূলের এই গোষ্ঠী কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ভাঙিয়ে বিজেপি বা বিরোধী দল শক্তি বাড়াবে। যে শক্তির জোগানদার তৃণমূল দল নিজেই।