জিয়াগঞ্জ ট্রিপল মার্ডার কেসে মূল অভিযুক্ত যুবক উৎপল বেহেরাকে হেফাজতে নিয়ে ম্যারাথন জেরায় বেরিয়ে এল একাধিক বিস্ফোরক তথ্য। যা রীতিমতো ঘটনার তদন্তকারী দল,সিআইডি থেকে শুরু করে জেলার দুঁদে পুলিশ কর্তাদের হতবাক করেছে। শুরু থেকে ওই পাল পরিবারের নৃশংস খুনের নীল নকশা তৈরিতে নবম শ্রেণি উত্তীর্ণ উৎপলের নিপুণতায় চোখ চড়ক গাছে উঠছে সকলের।
জানা গেছে এই খুনে যে 'মার্ডার ইউপন' ব্যবহার হয়েছিল,তা আদতে সাধারণ কোনও দোকান থেকে কেনা হাসুয়া কিংবা ধারালো অস্ত্র নয়। রীতিমতো প্ল্যান মাফিক তা স্পেশাল অর্ডার দিয়ে ন শো টাকার বিনিময়ে বানানো হয়েছিল। ওই চপার তৈরি করে খোদ সাগরদীঘির সাহাপুরের উৎপলের এক চেনা কামার। এই তথ্য পেয়েই পুলিশ সটান হাজির হয় ওই কামারের ডেরায়। রবিবার রাতের শেষ পাওয়া খবরে জানা যায় পুলিশি জেরাই ওই কামারও স্বীকার করেন তিনিই উৎপলকে ওই চপার বানিয়ে দেন। ফলে তদন্তকারী দলের কাছে এই মুহূর্তে পরিষ্কার হয়েছে গ্রেফতারের সময় উৎপল যে সব তথ্য দিয়েছিল, সবটাই ঠিক নয়। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ ধৃতকে মানসিকভাবে শান্ত করে তার কাছ ওই খুনের বিষয়ে আরও অনেক বিস্ময়কর তথ্য হাতিয়েছে।
গ্রেফতার হওয়ার পর ধৃত পুলিশকে শুরুতে জানায়, যে অস্ত্রটি খুনের কাজে লাগানো হয়েছিল তা নবমীর দিন নাকি আজিমগঞ্জ স্টেশন থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে কেনা হয়েছিল । প্রথম থেকেই এই অস্ত্র কেনা নিয়ে পুলিশের মনে সন্দেহ ছিল। জেরায় পুলিশের ওই সন্দেহ স্পষ্ট করে দিয়ে উৎপল পরে জানায় , একটি বিশেষ চপার পাড়ার এক কর্মকারের কাছে অর্ডার দিয়ে বানানো হয়েছিল । যার জন্য ন শো টাকা দিতে হয়েছিল ওই কর্মকারকেও । তদন্তের স্বার্থে পুলিশ এখনই ওই কর্মকারের নাম প্রকাশ্যে আনতে চাইছে না।এখানেই শেষ নয়,একদিকে ওই খুনের ঘটনার সময় উৎপল যে প্যান্ট পরে ছিল সেটিও পুলিশ স্থানীয় কবরস্থানের ঝোপ থেকে উদ্ধার করেছে।
উৎপল বেহেরা জেরায় স্বীকার করেছে, দরজা খোলার পর বন্ধু প্রকাশ পিছন ফিরে বিছানায় বসতে যান প্রথমে। ঠিক ওই মুহূর্তেই দুই হাতে শক্ত করে চপারের বাট ধরে এক কোপ বসাই ওই শিক্ষকের গলাই । এতেই তিনি বিছানায় লুটিয়ে পড়েন । সময় নষ্ট না করে ঘর টপকে ভিতরের বেডরুমে ঢুকে পড়ে উৎপল। তখন খাটের উপর দু পা লম্বা করে জড়িয়ে বসেছিলেন শিক্ষকের স্ত্রী বিউটি পাল । চপার দিয়ে তার গলাই কোপ বসিয়ে, তার পর তাদের ছ বছরের সন্তান অঙ্গন পালকে একই কায়দায় খুন করে সে । এরপর বিউটি দেবীর ঘরে ঢুকে উৎপল দেখে খাট থেকে একটি পা ঝুলছে । ওই পা টি নিজে হাতে খাটের উপর তুলে দেয় অপরাধী । এর পরই তার নজর পড়ে জানালার দিকে ।
বাইরে থেকে কেউ রক্তাক্ত বিউটি দেবীকে দেখে ফেলতে পারে তাই বিছানার চাদর দিয়ে তাকে ঢেকেও দেয় সে । এই সব করতে গিয়ে তার হাতে রক্ত লাগে তাই নিজের সঙ্গে থাকা গামছা দিয়ে হাত ও ইনস্যুরেন্সের বইটি মুছে নেয় । ইতিমধ্যে প্রথমে গেটে ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজ পায় সে ,পরে দরজার টোকা মারার শব্দ শুনে আর ঘরের মধ্যে অপেক্ষা না করে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায় । তাই সঙ্গে থাকা ব্যাগ আর নিয়ে যেতে পারেনি উৎপল । ওই ব্যাগ থেকেই রক্ত মোছা গামছা ও ইন্সুরেন্সের বই ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে পুলিশ । সাগরদীঘি থেকে ট্রেনে করে আজিমগঞ্জ থেকে নেমে সদর ঘাট হয়ে লেবুবাগান এসেছিল ওই যুবক। সদর ঘাটের সি সি টিভির ফুটেজ থেকে পুলিশ আগেই তার প্রমাণ পায় । কিন্তু ঘটনার পর সে লেবুবাগান থেকে মসজিদের পাশ দিয়ে সোজা না গিয়ে বা দিকে ঢালাই রাস্তা ধরে স্থানীয় গোরস্থানের পাচিল টপকে নিমতলা ঘাট পেরিয়ে আজিমগঞ্জ হয়ে ম্যাজিক গাড়ি করে সে সাহাপুর গ্রামে পৌঁছায় ।
তদন্তকারী এক পুলিশ কর্তা জানান , পুলিশ তার টি শার্ট উদ্ধার করেছে । এদিন তার বিবরণ থেকে জানতে পেরে গোরস্থান এলাকা থেকে প্যান্ট উদ্ধার করে । এদিকে নিমতলা ঘাটের সিসি ফুটেজে দেখা যায় সাদা রঙের গেঞ্জি ও থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে ঘাট পার হচ্ছে ওই অপরাধী । এই বিষয়ে জেলার এক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তা বলেন , ওর দেওয়া বিবরণ থেকে জানতে পারা গিয়েছে ,খুনের পর ও খুনের চিহ্ন লোপাট করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই দুধ ওয়ালার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আর সেই ঝুঁকি নিতে পারেনি সে । তাছাড়া মৃত বন্ধু প্রকাশের মোবাইলে ওই সময় ফোন আসছিল তাতেই খানিকটা ঘটনার পরেই অপ্রস্তুত হয়েই পালিয়ে যায়। বিজয়া দশমীর সকালে থালা ভর্তি পান্তা ভাত খেয়ে লেবুবাগানের উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে , জেরার মুখে এমন কথা স্বীকার করে উৎপল। এই দিন রাতে মুর্শিদাবাদ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তন্ময় সরকার বলেন,তথ্য সংগ্রহ করে ক্রমাগত পর্যায়ক্রমিক ভাবে তার বিশ্লেষণ চলছে। দ্রুত ঘটনার পুনঃনির্মান করা হবে। এর বেশি তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা সাম্ভব নয়।