রাজরাপ্পা যেন ঈশ্বরের সৃষ্টি করা পৃথিবীর স্বর্গ। জানা যায় আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে তৈরি হওয়া প্রাচীন দেবী ছিন্নমস্তার মূর্তি ও মন্দির রয়েছে এখানে।
রাজরাপ্পার (RajRappa) মা ছিন্নমস্তার মন্দির(Chinnomosta Temple) ঘিরে আজও ভক্তদের উন্মাদনা তুঙ্গে। দেবীর দশম মহাবিদ্যার ষষ্ঠ রূপ মা ছিন্নমস্তা। জায়গার নামের মধ্যেই যেন একটা গা ছমে ছমে বিষয়। বাংলা তথা পুরুলিয়ার (Purulia) পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের (Jharkhand) রামগড় জেলার রাজরাপ্পার মা ছিন্নমস্তা মন্দিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভক্তরা নানান সমস্যার সমাধানে শত কষ্টের মধ্যেও মায়ের কাছে পুজো দিতে পৌঁছান। আজও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পন্ডিতরা চন্ডীপাঠ করতে আসেন। কালীপুজোয় তৈরি হয় এক অন্যরকম পরিবেশ।
রাজারাপ্পার মা ছিন্নমস্তা মন্দিরে আজও শুনতে পাওয়া যায় দেব দেবীদের অজানা ইতিহাস। চারিদিকে পাহাড় জঙ্গল ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক মনোরম পরিবেশে তৈরি হওয়া রাজরাপ্পা যেন ঈশ্বরের সৃষ্টি করা পৃথিবীর স্বর্গ।
জানা যায় আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে তৈরি হওয়া প্রাচীন দেবী ছিন্নমস্তার মূর্তি ও মন্দির রয়েছে এখানে। পুরুলিয়া শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দুরে রাজরাপ্পা মন্দির। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত রূপ সেখানে উজাড় করে দিয়েছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর,চারিদিকে পাহাড় এবং জঙ্গলেঘেরা দুর্গম মনোরম এক পরিবেশ।
এখানে দেবী দর্শনে ও মা ছিন্নমস্তার পুজো পাঠের জন্য দৈনিক গড়ে পাঁচ ছয় হাজার মানুষ আসেন। দর্শনার্থী ও ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে দুর্গা পুজো এবং কালী পুজোর সময়ে। তবে কালী পুজোর সময় ভিড় হয় সবচেয়ে বেশি। সারাবছর ধরে দৈনিক গড়ে এক হাজার পাঁঠা বলি হয় এখানে।
দামোদর নদ ও ভৈরবী নদীর মিলন স্থলে রয়েছে এই দেবী মন্দির। অন্যদিকে এই দুটি নদ নদীর মিলন যেন নদের বুকে নদী শুয়ে আছে ঠিক তেমনই। এখানে দামোদর নদের উপর কোনো মাটি বালি নেই, জল সারাবছর ধরে ঠান্ডা, শুধু পাথরের উপরে দিয়ে বয়ে চলেছে নদ। ঠিক একই ভাবে পাথরের ওপর বয়ে চলেছে ভৈরবী নদী তার গরম জল নিয়ে। এ যেন এক অপরূপ দৃশ্য।
এখানকার ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রাচীন কালে এই স্থানের নাম ছিল রাজতপা। রামগড়ের তৎকালীন রাজা পদ্মারাজ এই গভীরতম দুর্গম অরণ্যের মধ্যে দামোদর নদ ও ভৈরবী নদীর মিলন স্থলে তপস্যা করতেন। কথিত আছে এই পদ্মরাজাই দেবী ছিন্নমস্তার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন সিদ্ধপীঠ বানিয়ে। পরবর্তী সময়ে আদি গুরু জগৎ শংকরাচার্য্য এই মন্দিরে পুজো করতেন। তারও পরে কলকাতা থেকে আসা পুরোহিত রুদ্রনারায়ণ ঘোষাল পুজো করতেন। বর্তমানে তাঁরই বংশধরেরা বংশপরম্পরায় এখানকার পুরোহিত।
মন্দিরের গর্ভগৃহে মায়ের যে মূর্তিটি রয়েছে তা যেমন নদের উপর নদীর মিলন ঠিক তেমনই কামের উপর শুয়ে আছে রতি। আর তাঁদের উপরে দাঁড়িয়ে দেবী ছিন্নমম্তার মূর্তি। এখানকার ইতিহাস থেকে জানা যায় দক্ষপ্রজাপতি এক বৃহৎ দক্ষযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সমস্ত দেব দেবীর আমন্ত্রণ ছিল সেখানে। কিন্তু দেবাদিদেব শিবের আমন্ত্রণ ছিল না। কারণ মহাদেব শিবকে জামাতা রূপে মেনে নিতে পারেননি দক্ষপ্রজাপতি।
Kalipuja 2021- এই গ্রামে আলো জ্বালেন মা মৌলিক্ষা, মা কালীর সঙ্গে পুজো পান বামাক্ষ্যাপাও
Kalipuja 2021- ধুপধুনোর গন্ধে মা কালীকে অনুভব, বয়রা গাছের নীচে শুরু হল কালীপুজো
যজ্ঞের খবর পেয়ে দেবী দুর্গা শিবের কাছে সেখানে যাওয়ার মত পোষন করেন। কিন্তু শিব তাতে অনুমতি দেননি। বহু আবেদন নিবেদন করেও দেবী দুর্গা শিবের কাছে ঐ যজ্ঞস্থলে যাওয়ার অনুমতি পাননি। পরে গোপনে দেবী দুর্গা শিবের অনুমতি ছাড়াই ঐ মহা-যজ্ঞে উপস্থিত হন। এদিকে দক্ষপ্রজাপতিও তাঁর কন্যাকে দেখে খুশি হন। অন্যদিকে এখবর পেয়ে ক্রোধিত হন মহাদেব। যজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার পর দেবী দুর্গা তাঁর দশম মহাবিদ্যার রূপ ধারণ করেন। এবং মহাদেবকে দেখিয়ে দেন সৃষ্টি ও বিনাশ উভয়েই তাঁর ক্ষমতায়। এবপরেই দেবী তাঁর মুন্ডু ছেদন করেন।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও এই রাজরাপ্পায় দেবী ছিন্নমস্তার মন্দিরে দুর্গা পুজো এবং কালী পুজোয় চন্ডী পাঠ করার জন্য দেশের বহু বড় বড় পন্ডিতেরা এসে উপস্থিত হন। জানা যায় পন্ডিত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রও এখানে এসে চন্ডীপাঠ করেছেন।
ভারতবর্ষের একটি অন্যতম তীর্থক্ষেত্র ও পর্যটন কেন্দ্র বলা হয় এই রাজরাপ্পাকে। কালীপুজোর সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ এখানে আসেন। ঝাড়খন্ড সরকার এই স্থানটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে রিসর্ট, রেস্টুরেন্ট, পার্ক বানিয়েছে। সবমিলিয়ে এখন এখানে হাজারেরও বেশি ছোটো বড় বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান তৈরি হয়েছে। আর তাই রাজারাপ্পা বর্তমানে ধর্মীয় পর্যটন ক্ষেত্রের এক আদর্শ জায়গা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।