ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেরে বিপুলভাবে ক্ষতির সম্মুখিন রাজ্য। এই পরিস্থিতিতে পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার এবং পুনর্গঠনের উপরে জোর দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নবান্নে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই ঘূর্ণিঝড় আমফানের ফেলে যাওয়া ক্ষতের মেরামত এবং বিপর্যস্ত জনজীবনকে নতুন করে কীভাবে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানো যায়, তা নিয়ে এক রোডম্যাপের ঘোষণা করেন। সেখানেই তিনি ১০০০ কোটি টাকার এক অর্থ তহবিল গঠন করার কথাও জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেরে বিপুলভাবে ক্ষতির সম্মুখে দুই ২৪ পরগণা। এমনকী কলকাতার ক্ষতির বহরও কোনও অংশে কম নয় বলে জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, কলকাতায় ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডব তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন তাতে তিনি আতঙ্কিত জেলার কথা ভেবে। তিনি জানান, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনায় ঘূর্ণিঝড় আমফান তাণ্ডব চালানোর জন্য বিশাল ফাঁকা এলাকা পেয়েছে। ফলে খুব সহজেই সেখানে ধ্বংসের চূড়ান্ত খেলা খেলেছে আমফান। তাঁর কথায়, দুই ২৪ পরগণা এক্কেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আমফান যে ক্ষতি করেছে তা আয়লার থেকেও অনেকবেশি। জায়গায়-জায়গায় রাস্তা উড়ে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে কালভার্ট, ছোটখাটো ব্রিজ। ব্যাপকভাবে ক্ষতি হয়েছে ধানচাষের। প্রভাবিত হয়েছে চাযের জমি। এমনকী, মৎস্যজীবীরাও রুটি-রুজি হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই বেনজির প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সামলাতে তাই সামগ্রিক উন্নয়নের উপরে জোর দিয়েছেন তিনি।
নবান্নে বৃহস্পতিবার দুপুরে এক উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ক্যাবিনেটের সমস্ত মন্ত্রী থেকে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের উচ্চ-পদস্থ আধিকারিক থেকে শুরু করে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের বহু উচ্চ-পদস্থ সচিব এবং যুগ্ম-সচিবরা এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই বিস্তারিতভাবে ঘূর্ণিঝড় আমফান পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠকে বসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুরুতেই তিনি বুঝিয়ে দেন, এই মুহূর্তে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার-এর উপর জোর দেওয়াটাই তাঁর লক্ষ্য। সেই কারণে তিনি একদিকে যেমন ১০০ দিনের কাজের উপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। তেমনি, আমফানের ধ্বংসলীলায় যে সব মানুষ রুটি-রুজি হারিয়েছেন তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের দিকেও নজর দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে জানান, মানুষের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। শেষ হয়ে গিয়েছে দুই ২৪ পরগণা। কোন এলাকায় কত ক্ষতি- এটা পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে জানতে গ্রাম ভিত্তিক সার্ভে করারও নির্দেশ এদিনের বৈঠকে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রতিটি দফতর ধরে ধরে তিনি এদিনের বৈঠকে রোডম্যাপ এঁকে দেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন, পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার এবং পুনর্গঠনের কাজে কোনও গাফিলতি তিনি বরদাস্ত করবেন না। যে যে এলাকায় রাস্তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, সেখানে ১০০ দিনের কাজের আওতায় রাস্তা মেরামতি-র নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। ইঁট পেতে যাতে যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করা যায় তার জন্য নজর দিতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাস্তা যাতে ৩ বছর অন্তত টিকতে হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। কৃষিতে ক্ষতির বহর কতটা, তা জানতে রিপোর্টও তলব করেছেন। মৎস্যজীবীরা এই মুহূর্তে সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে জীবন বিপন্ন হতে পারে। আবার বহু মাছ ধরার ট্রলারও আমফানের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই কারণে ১০০ দিনের কাজের আওতায় মৎস্যজীবীদের স্থানীয় পুকুর বা জলাশয়ে মাছ চাষের বন্দোবস্ত করা যায় কি না তা খতিয়ে দেখতেও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও এদের জল ভরো-জল ধরো প্রকল্পের আওতায় আনা যায় কি না তাও পর্যালোচনা করে দেখতে প্রশাসনকে বলেছেন।
ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেরে কলকাতা, দুই চব্বিশ পরগণা এবং নদিয়া জেলার ৫০ শতাংশ গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।এমনকী, প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে ম্য়ানগ্রোভ। এর সূদূর প্রভাব রাজ্যের পরিবেশ-প্রকৃতির উপরে পড়বে বলেই আশঙ্কা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই সুন্দরবনে অবিলম্বে বৃক্ষ রোপণ, বিশেষ করে ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ রোপণ এবং অন্যান্য জেলায় অন্যান্য চারা-গাছ রোপণের কাজ শুরু করতেও বন-দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন। হাঁস-মুরগি-ছাগল পালনে স্বনির্ভরগোষ্ঠীগুলিকে আরও কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়েও পর্যোলচনা করতে বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে সব স্কুল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ছাদ উড়ে গিয়েছে, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তা মেরামতির নির্দেশ দিয়েছেন। এর জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় হওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় আমফানের রাগড-আই যখন কলকাতার উপরে, তখন তার লেজটা গিয়ে আঘাত করেছে রাণাঘাটে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কতটা ব্যাপকভাবে ক্ষতি করেছে ঘূর্ণিঝড় আমফান। এতবড় এলাকা জুড়ে তিন ঘণ্টা ধরে যাবে ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে ঘূর্ণিঝড় আমফান অগ্রসর হয়েছে তা বেনজির। এহেন এক পরিস্থিতিতে ক্ষতির অঙ্কের সঠিক রিপোর্ট এখনই পাওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই সঠিকভাবে এই মুহূর্তে সত্যিকারে ক্ষতির অঙ্ক অনুমান করা সম্ভব নয় বলেই তিনি জানিয়েছেন। তিনি পুর্ণাঙ্গ রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন বলেও জানিয়েছেন মমতা। আশা করছেন এই বিষয়ে ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেয়ে যাবেন।
এই প্রসঙ্গেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, একে করোনার জেরে রাজ্য সরকারের ভাড়ার শূণ্য। তারপরে আবার এই ঘূর্ণিঝড় আমফান। এছাড়াও বর্ষা আসছে এবং গ্রীস্মকাল চলছে। এহেন অবস্থায় অর্থ তহবিল গঠন নিয়ে রাজ্য যে অসুবিধায় তা জানান তিনি। সেই কারণে কেন্দ্রের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র কাছে বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল থেকে তিনি সাহায্য দাবি করেছেন বলেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে, এই মুহূর্তে পরিস্থিতি যা তাতে অর্থের অভাবে বলে পিছু হঠা যাবে না বলেও মনে করছেন। তাই প্রয়োজনে ধার করেও আমফানের ক্ষতি-র মোকাবিলা করবেন বলেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।