বহুক্ষণ চেষ্টা করে দরজা খুলতে না পেরে দরজা ভেঙে গ্রামবাসীরা ভিতরে প্রবেশ করে। তারপরেই ঝলসানো অবস্থায় এক এক করে ঐ তিন জনকে উদ্ধার করেন তাঁরা।
আজও 'মেয়ে' (Girl Child) হয়ে জন্মানো বা 'কন্যা' সন্তানের জন্ম দেওয়া যেন সামাজিক অপরাধ (Crime) এক শ্রেণীর মানুষের কাছে। তাই মুর্শিদাবাদের (Murshidabad) গাঁতলা এলাকায় আড়ালে-আবডালে রবিবার ঘটে গেল চরম লজ্জাজনক ঘটনা। তা চাউর হতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে সব মহলে। চারিদিকে যখন বড়াই করে 'উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট' কথাটির ফলাও করে প্রচার করা হয়, তখনই প্রদীপের তলায় অন্ধকার।
জোড়া কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধ করেছিলেন লক্ষ্মী ঘোষ। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের হাতে শারীরিক-মানসিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে অপমানিত হওয়ার পর চরম পথ হিসেবে জন্মদাত্রী ঐ মা দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করলেন প্রকাশ্যে।
ঘরের মধ্যে থেকে গল গল করে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে দেখে সেইসঙ্গে আর্তনাদ শুনে গ্রামের প্রতিবেশীরা ছুটে আসে ঐ মহিলা লক্ষ্মী ঘোষ ও তার দুই শিশু কন্যা সন্তান বছর চারেকের চাঁদনী, ইতু ঘোষকে বাঁচাতে। বহুক্ষণ চেষ্টা করে দরজা খুলতে না পেরে দরজা ভেঙে গ্রামবাসীরা ভিতরে প্রবেশ করে। তারপরেই ঝলসানো অবস্থায় এক এক করে ঐ তিন জনকে উদ্ধার করেন তাঁরা।
পুলিশ এসে তাদের হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসক সেখানেই তাদের মৃত বলে ঘোষণা করেন। এদিকে এমন নির্মম ঘটনায় রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেছে গোটা গ্রাম। সকলেই আঁতকে উঠেছেন এই পরিণতির কথা জানতে পেরে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গাঁতলা গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের দয়াল ঘোষের মেয়ে লক্ষ্মী ঘোষের সঙ্গে ২০১৭ সাল নাগাদ লালবাগ মহাকুমার নবগ্রামের বীরবল ঘোষের বিয়ে হয়। এই পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও বছর দেড়েক পরেই তাদের কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
তারপর থেকেই লক্ষ্মীর জীবনে নেমে আসে অলক্ষ্মীর ছায়া। অভিযোগ, নানান অছিলায় হতভাগ্য লক্ষ্মীর উপর তার স্বামী বীরবল সহ শশুর বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা অকথ্য শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালাত। এমনকি তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেরে ধরে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।এরপর থেকে কয়েক বছর কেটে গেলেও আর লক্ষ্মীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলেই মৃতার পরিবারের দাবি। এদিকে এমন ঘটনা ঘটায় লক্ষ্মী ক্রমশ মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
পাশাপাশি দুই মেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পড়ে সে। কিভাবে ওই দুই শিশু কন্যার খরচ টানবে লক্ষ্মী পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে এই নিয়ে নানান ধরনের মানসিক ভাবনায় ক্রমশ অবসাদে চলে যেতে শুরু করে লক্ষী। এমনকি কয়েক দিন ধরে পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল ওই গৃহবধূ বলে স্থানীয়রা জানান। তারপরেই লক্ষ্মী বেছে নেয় এই চরম পথ। নিজের ২ দুধের কন্যা সন্তানকে নিয়ে ঘর বন্দী অবস্থায় গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় সে। মুহুর্তের মধ্যে তিন জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।
মৃতের বাবা দয়াল ঘোষ বলেন," এইভাবে তিন তিনটে তরতাজা প্রাণ চলে যাবে তা আমি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করে উঠতে পারিনি। আমার পরিবারে নাতনি মেয়ে বলে আর কেউ রইল না। অভিযুক্তদের কঠোর সাজা হওয়া দরকার"। ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। যদিও শেষ পাওয়া খবরে এই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি বলেই জানা গেছে। সুবিচারের আশায় চেয়ে রয়েছে হতভাগ্য লক্ষ্মীর পরিবার।