সকাল থেকেই মেয়ের সঙ্গে কথা। সন্ধে থেকে সমানে ফোন করে যাচ্ছিলেন বাবা। অথচ জানতেন না ততক্ষণে মেয়ে খুন হয়ে গিয়েছে। কীভাবে জানতে পেরেছিলেন মেয়ের মৃত্যু সংবাদ? কীভাবে ছুটে এসেছিলেন বহরমপুরে? খুনে অভিযুক্ত সুশান্তের সঙ্গে সুতপার কী সম্পর্ক? তা নিয়ে মুখ খুলেছেন সুতপার বাবা স্বাধীন চৌধুরী।
টাকার দরকার ছিল সুতপার। এই নিয়ে সোমবার সকাল ৯টার সময় মেয়ে সুতপার সঙ্গে ফোনে কথাও হয়েছিল স্বাধীনের। কিন্তু কত টাকা লাগবে তা ঠিক করে বলেনি সুতপা। কলেজের সময় হয়ে যাওয়ায় ফোন কেটে দিয়েছিল সে। শুধু জানিয়েছিল যে সন্ধ্যায় ফোনে কথা হলে সে বলে দেবে। এরপর সন্ধের আগে থেকেই সুতপাকে ফোন করছিলেন বাবা স্বাধীন। কিন্তু, সুতপা ফোন ধরেনি। শেষপর্যন্ত মেয়েকে ফোনে না পেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ-এ মেসেজ করেন স্বাধীন। সেই মেসেজ তিনি যখন করেছিলেন তখন সন্ধে ৬টা ৫০ মিনিট। এর মিনিট দশেক পরেই বহরমপুর থানার আইসি-র ফোন পান স্বাধীন চৌধুরী। পুলিশ অফিসার জানান, সুতপার দুর্ঘটনা হয়েছে। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি রয়েছে। অবিলম্বে তাঁকে বহরমপুরে আসতে হবে।
স্বাধীন জানিয়েছেন, রাতেই তিনি বহরমপুরে পৌঁছে যান। তার আগেই ফোনে যেটুকু আভাষ পেয়েছিলেন তাতে বুঝতে পেরেছিলেন গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে। মেয়ে সুতপাও যে আর বেঁচে নেই তাও কথায় কথায় বুঝতে পেরেছিলেন। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছতেই নিশ্চিত হন যে সুতপা আর বেঁচে নেই। মালদহ ইংরেজবাজার এলাকায় তাঁদের বাড়ির সামেন বসবাস করা সুশান্ত খুন করেছে সুতপাকে।
মঙ্গলবার সকালে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্বাধীন জানান, মালদহে তাঁর বাড়ির কাছেই থাকে সুশান্ত। বাইরে কোথাও একটা পড়াশোনা করে। তবে সুতপার সঙ্গে সুশান্ত-র প্রেমের কোনও সম্পর্ক ছিল-এমন কথা স্বীকার করেননি তিনি। তবে জানিয়েছেন, প্রায়ই সুতপা তাঁর কাছে সুশান্ত-র নামে অভিযোগ করত। সুতপা অভিযোগ করেছিল সুশান্ত নানা কুরুচিকর মেসেজ পাঠায়। এমনকী সম্পর্কে না জড়ালে সুশান্ত তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে মেসেজ করেছে বলেও নাকি বাবা স্বাধীন চৌধুরীর কাছে অভিযোগ করেছিল। এরপরই স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দ্বারস্থ হয়েছিলেন স্বাধীন। কাউন্সিলারের মধ্যস্থতায় সুতপা ও স্বাধীনের মুখোমুখি আলোচনায় বসেছিল সুশান্ত ও তার পরিবার। সুশান্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সে কোনও দিন সুতপাকে মেসেজ পাঠাবে না এবং অনুসরণ করবে না। কিন্তু, এরপর থেকেও ফেসবুকে সমানে সুতপার নাম না করে হুমকি বয়ান পোস্ট করেছিল সুশান্ত। এমনও অভিযোগ সামনে এসেছে।
সুতপার বাবা স্বাধীন চৌধুরীর মেয়েকে হারিয়ে কার্যত ভেঙে পড়েছেন। ভাবতেই পারছেন না যে মেয়ে নেই। যার সঙ্গে সকাল কথা হল সে কীভাবে বিকেলের মধ্যে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে পারে তার কূলকিনারা করতে পারছেন না স্বাধীন। সুশান্তকে তিনি দুষ্টু ছেলে বলে সম্বোধন করেছেন। বলেছেন শেষমেশ এই দুষ্টু ছেলেটার হাতেই সুতপাকে মরতে হল। এর বেশি আর কোনও কথা বলতে পারেননি স্বাধীন চৌধুরী।
এদিকে, মালদহের ইংরেজবাজার থানা এলাকায় বসবাসকারী সুশান্তের পরিবার গোটা ঘটনায় কিমকর্তব্যবিমূঢ়। সুশান্ত যে মালদহ এবং বহরমপুরে রয়েছে- একথা নাকি তাঁরা জানতেন না। বেশকিছুদিন আগে সুশান্ত পাটনায় পড়াশোনা করতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু কবে সুশান্ত পাটনা থেকে ফিরে এল এবং কখন বহরমপুরে গেল তা নাকি ঘূণাক্ষরেও জানতে পারেনি পরিবার। এমনই বয়ান দিয়েছেন সুশান্তের ভাই।
সুশান্তের পরিবার সূত্রে খবর, মাস দুয়েক ধরে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে থাকত সুশান্ত। কিছু বললেও রেগে যেত। যখন-তখন যাকে তাকে মেরে দিত। বেশি কথাও বলত না। পুরো পাগল পাগল দশা ছিল। বাড়ির লোক মনে করেছিল সুতপার সঙ্গে সম্পর্কের বিচ্ছেদেই হয়তো এমন পরিস্থিতি। তারা আশা করেছিলেন পাটনাতে থাকা সুশান্ত পড়াশোনায় মন দেবেন এবং ভুলে যাবেন সুশান্তকে।
বহরমপুর গার্লস কলেজে বায়োলজি নিয়ে পড়াশোনা করতেন সুতপা। সোমবার বিকেলে তিনি স্থানীয় একটি মলে গিয়েছিলেন শপিং করতে। সেখান থেকে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসেন তিনি। মেসে ঢুকতেই সুতপার ফোনে একটা ফোন এসেছিল বলে জানা গিয়েছে। এই ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সুতপা বাইরে বেরিয়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, রাস্তায় বেরিয়ে কিছুটা এগোতেই পিছন থেকে সুতপার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুশান্ত। এরপর হাতে থাকা ধারাল অস্ত্রের এলোপাথাড়ি কোপ দিতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে রাস্তায় রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যায় সুতপা। স্থানীয়রা সুতপার দিকে এগনোর চেষ্টা করতেই সুশান্ত ছুরি নিয়ে হুমকি দিতে থাকে। এরপর সে পিস্তল বের করে হুমকি দিতে দিতে এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। রাত ১০টা নাগাদ সুশান্তকে মুর্শিদাবাদের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে সামশেরগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার হওয়ার সময় সে মোটরবাইকে করে মালদহের দিকে পালাচ্ছিল বলে জানা গিয়েছে। রক্তাক্ত সুতপাকে ততক্ষণে বহরমপুর মেডিক্য়াল কলেজের চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। বহরমপুর থানা থেকেও সুতপার বাবাকে ফোন করে অবিলম্বে মালদহ থেকে চলে আসতে বলা হয়েছিল। পরে পুলিশ জানায় সুশান্ত-র কাছ থেকে একটি ব্যাগ পাওয়া গিয়েছে। সেই ব্যাগে একটু ব্লেড ও রক্তমাখা ছুরি ছিল। এছাড়াও একটি খেলনা বন্দুক ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয়েছে।
আরও পড়ুন- কেন খুন হতে হল মালদহ ইংরেজবাজারের বাসিন্দা কলেজ ছাত্রী সুতপাকে, পিছনে রয়েছে কোন কারণ
আরও পড়ুন- মহিলা সংক্রান্ত বিবাদ, তাই কি এক পরিবারের তিন সদস্যকে গলার নলি কেটে খুন
আরও পড়ুন- বিয়ের আগেই তরুণীর দেহ উদ্ধারের ঘটনায় ধৃত প্রেমিক, ১০ বছরের সম্পর্কে ইতি টানতে চাইছিল কে
আরও পড়ুন- 'বিয়েতে রাজি না হওয়ায় প্রেমিকাকে খুন', হলদিয়াকাণ্ডে ৭ দিনের আগেই সাফল্য পুলিশের, ধৃত প্রেমিক