
পরিবারে অভাব ছিল বরাবরই। তারই মধ্যে বড় হয়ে উঠেছেন। মাধ্যমিক পাশ করার পর প্রথমে টেলারিংয়ের প্রশিক্ষণ নেন। তারপর নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে কাজ শুরু করেন। ইচ্ছা ছিল নার্স হিসেবেই কাজ চালিয়ে যাবেন। কিন্তু ১৯ বছর বয়সে হঠাৎই জীবনে নেমে এল বিপর্যয়। বাবার মৃত্যু হল। বাবা কাজ করতেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের কল্যাণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পুরন্দরপুর মঠ জোড়ামন্দির মহাশ্মশানে। বাবার মৃত্যুতে তখন দিশেহারা পরিবার। সংসার কীভাবে চলবে জানা নেই। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য এবং উপপ্রধানের কথায় শ্মশানে বাবার কাজই শুরু করে দেন টুম্পা দাস। সালটা ছিল ২০১৪। তখন এই শ্মশানে কাঠের চুল্লি। একমাত্র মহিলা কর্মী টুম্পা। শুরুতে ভয় লাগত বলে মাকে নিয়ে যেতেন। তারপর একাই কাজ চালাতে থাকেন। এক দশক পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও শ্মশানেই কাজ করে চলেছেন টুম্পা।
নার্সিং ছেড়ে কেন শ্মশানে কাজ?
টুম্পা জানালেন, 'আমি নার্স হিসেবে যেখানে কাজ করতাম, সেখানে ৩,০০০ টাকা বেতন পেতাম। শ্মশানে কাজের জন্যও আমাকে ৩,০০০ টাকাই দেওয়া হবে বলে জানানা হয়েছিল। নার্সিং হোমে যাতায়াত করতে মাসে ২০০-৩০০ টাকা খরচ ছিল। আমার তখন যা অবস্থা, তাতে এক টাকা বাঁচাতে পারলেই অনেক। এই কারণে বাড়ির পাশে শ্মশানে কাজ শুরু করে দিই। তখন সংসার চালানো ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি। আত্মীয়-পরিজনরা অনেকেই শ্মশানে কাজ করতে বারণ করত। মাকে বলত, মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র পাবে না। গ্রামের অনেকেই আমি যে রাস্তা দিয়ে যেতাম সেই রাস্তা থেকে সরে যেত। পরে তারাই আত্মীয় বা পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হলে শ্মশানে এসে আমার খোঁজ করেছে।'
শ্মশানে কাজ করতে কী ধরনের সমস্যা হয়েছে?
টুম্পা জানালেন, 'আমি শ্মশানে রেজিস্টার মেনটেন করি। আবার প্রয়োজনে চিতাও সাজাই। শুরুতে কাঠের চুল্লি ছিল। তখনও চিতা সাজিয়েছি। টানা আড়াই বছর ছুটি পাইনি। প্রতিদিন কাজ করেছি। তখন একাই কর্মী ছিলাম। ফলে ২৪ ঘণ্টাই সতর্ক থাকতে হত। গভীর রাতেও শ্মশানে আসতে হয়েছে। শুরুতে শ্মশানে একটা মেয়ে কাজ করছে দেখে অনেকে অবাক হত। পরে সবাই বুঝে গিয়েছে। এখন আর সমস্যা হয় না। বরং পুরুষ সহকর্মীরা সমস্যায় পড়লে আমাকে ডাকে। কেউ ঝামেলা করলে আমি পরিস্থিতি সামাল দিই। এখন সবাই আমাকে সম্মান করে, বলে আমি ভালো কাজ করি। স্কুলের বন্ধুরা যখন আনন্দ করত, ঘুরে বেড়াত, তখন আমি শ্মশানে কাজ করতাম। আমার দুঃখ হলেও কিছু করার ছিল না। এখন ওদের সঙ্গে দেখা হলে বলে, বিয়ে করিসনি ভালো আছিস।'
পরিবার কী বলছে?
টুম্পার মা বিনতা দাস জানালেন, 'টুম্পার বাবা মারা যাওয়ার পর ওকে শ্মশানে কাজ করতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন পরিবারের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ফিরেছে। টুম্পার বিয়ের জন্য সম্বন্ধও আসছে। আমরা এখন আগের চেয়ে ভালো আছি। সবাই বলে, আমার মেয়ে ভালো কাজ করে। ওর জন্য আমি গর্বিত।'
টুম্পার সহকর্মীরা কী বলছেন?
শ্মশানে টুম্পার সহকর্মী অজিত দাস জানালেন, 'টুম্পা আগে থেকে কাজ করছে। আমি পরে কাজে যোগ দিয়েছি। আমরা পরিবারের মতো থাকি। ওদের বাড়ি থেকে অনেক সময় আমার খাবার পাঠায়। আমরা মিলে-মিশে কাজ করি।' পুরোহিত রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, 'আমরা একসঙ্গে মিলে কাজ করি। টুম্পা মেয়ে বলে কিছু মনে হয় না। ও ভালো কাজ করছে। কোনও সমস্যা নেই।'
আরও খবরের আপডেট পেতে চোখ রাখুন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে, ক্লিক করুন এখানে।