সংক্ষিপ্ত

  • ভার্সেটাইল গায়ক কিশোর মানেই এক ভিন্ন আবেগ
  • যাঁর গলায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ ভরে যায়
  • যতটা আনন্দের সঙ্গে তিনি প্রতিটি গানে প্রাণ ঢেলে দিতেন
  • ততটাই প্রাণবন্ত ছিল চেনা-অচেনা কিশোর কুমারের নানান কাণ্ড

কে বলে আমি পাগল

নানান মজার কীর্তি, তবে  তাকে পাগলামো বলতে নারাজ তিনি। গান নিয়ে উন্মাদনাই তাঁর জাীবনের মূল পাথেয়। অথচ সবার কাছে একদিন এই পাগল গায়কই সোচ্চার হয়ে বললেন- 'কে বলে আমি পাগল'। ১৯৮৫ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই তিনি প্রতিবাদ করে জানিয়েছিলেন- 'গোটা পৃথিবী পাগল আমি নই'। তাঁর গান, তাল, লয়, ছন্দে বাঁধা জীবন চরাচরের অভিব্যক্তি তাঁকে করে তুলেছিল সকলের চেয়ে ভিন্ন এক মেলোডি আইকোন-কিশোর কুমার। 

কান্না ঘিরে বিভ্রাট

নিজের কণ্ঠের কারুকার্যে গান নিয়ে কিশোর কুমারের উন্মাদনা প্রতিটি পলকে নজর কাড়ত সকলের। তাঁর গানের ভঙ্গী ছিল চমকদার ও প্রাণবন্ত। শুধু নিজেই উপভোগ করতেন না, রেকর্ডিং-এ উপস্থিত সকলের মনে এক এলাদা রসের সঞ্চার করাটাই ছিল তাঁর স্বভাবের এক বিশেষ দিক। তাই তো নানান মজার ঘটনায় সাজানো তাঁর গল্পগাঁথা। কেবল গানের মঞ্চে বা সিনেমার পর্দায় নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও বেজায় রসিক মানুষ ছিলেন তিনি। রসিকতার সূত্রপাত সেই বাল্যকাল থেকেই। অর্থাৎ যখন কৈশোরের কিশোরের কণ্ঠস্বর ছিল তাঁর জীবনের বড় বিস্ময়। গলার স্বর কর্কশ। এদিকে স্বপ্ন দেখা, গায়ক হওয়ার, নিজের স্বপ্নের আইডল কে.এল.সইগলের সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু ছোট্ট কিশোরের জীবনে, মিরাকেল ঘটাতে খুব বেশি সময় নিল না তাঁর ভাগ্য।

কণ্ঠে এলো সুর 

হঠাৎই একদিন খেলার সময় পা কেটে গেলে কিশোর তৈরি করেছিলেন এক হুলুস্থুল পরিবেশ। তারস্বরে কান্নায় বাড়ি উঠল মাথায়। মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রায় দেড় ঘণ্টার প্রচেষ্টায় থামল তাঁর কান্না। অথচ হতবাক হলেন সকলেই। সেই কর্কশ স্বর যেন পলকে উধাও। পরিবর্তে গলার স্বর পরিণত হয়েছে এক মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে। সেই থেকেই শুরু পথ চলা। 
দাদা অশোক কুমারের উদ্যোগে পাড়ি দেওয়া সইগল সাহেবের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত নিরাশ হতে হয় তাঁকে। আর তারপরই রচনা হল বাংলা-হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের সেই কালজয়ী অধ্যায়। কিশোর-আর.ডি বর্মন ও রাজেশ খান্না জুটি।

শো ছেড়ে পলাতক 

কিশোর মানেই এনার্জিটিক লাইভ শো, অথচ প্রথম জীবনে সাধারণত কোনও মিউজিক্যাল শো হলে কিশোর গান গাইতে ভয় পেতেন, পালিয়ে যেতেন দিনের দিন। নানান সময় নানান ব্যক্তির ওপর দায় বর্তাত তাঁকে তুলে নিয়ে আসার। একবার মুম্বইয়ে সকলের নেপথ্যে কণ্ঠ শিল্পীদের দিয়ে গান গাইয়ে ফান্ড কালেক্ট করার উদ্যোগ নেওয়া হল। যথারীতি কিশোর কুমার নিজের বাড়ির গেটে তালা ঝুলিয়ে লাপাতা। পরে অনেক কষ্টে কল্যানজী-আনন্দিজীর প্রচেষ্টায় সেই ভীতি কাটে কিশোর কুমারের।

সেট থেকে উধাও

শুধু যে গানের ক্ষেত্রেই কিশোরের কৌশোরিক মনোভাব মাথায় হাত ফেলত সকলের এমনটা নয়, অভিনয়ের ক্ষেত্রেও তিনি বেশ ভুগিয়েছেন পরিচালকদের। স্বাধারণত শ্যুটিং স্পটে পরিচালকদের মতই চুরান্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু কিশোর কুমার কোনও কথাই শুনতেন না। তাই এক পরিচালক একবার পৌঁছে গিয়েছিলেন কোর্টে। সেখান থেকে নির্দেশ জারি করে এনেছিলেন, স্পটে যেন কিশোর কুমার পরিচালকের কথা মেনেই চলেন। এতেই ঘটে বিপত্তি। কিশোর কুমার একটি দৃশ্যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, পরিচালক ভুলে গেলেন কাট বলতে। তাই কিশোর কুমারও থামলেন না। গাড়ি চালিয়ে সেট ছেড়েই বেড়িয়ে গেলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন পরিচালক কাট বলেননি তাই তিনি বাড়ি চলেগিয়েছেন। 

আধা টাকা-আধা মেকআপ

নিজের সিদ্ধান্তেই কিশোর কুমার থাকতেন অনঢ়। অপচ্ছন্দের কোনও বিষয়কে মজার ছলে সহজেই তুলে ধরতেন সকলের সামনে। যেমন গোটা ইন্ডাস্ট্রি জানত, কিশোর কুমার টাকার বিনিময়ে কাজ করাটাই বেশি পছন্দ করতেন। কেউ টাকার বিষয় খামখেয়ালি হলেই তিনি সেদিক থেকে সরে আসতেন। একবার সিনেমার প্রস্তাব পেয়ে কিশোর কুমার উপস্থিত হন শ্যুটিং স্পটে। অর্ধেক টাকা দিয়ে পরিচালক কাজ শুরু করতে চান তড়িঘড়ি। অথচ শ্যুটিং শুরু হলে কিশোর কুমারকে দেখে পরিচালকের চক্ষুচড়ক গাছ। কিশোর কুমারের মুখে রয়েছে অর্ধেক মেকআপ। প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে আধা পয়সা-আধা মেকআপ। 

চুল কাটতে নেড়া

একটা সময় ছিল কিশোর কুমারের চাহিদা অভিনেতা হিসেবে বাড়তে থাকে। তখন তিনি এক সেট থেকে ছুঁটছেন অন্য সেটে। সংলাপও ফেলতেন গুলিয়ে। রোম্যান্টিক সিনে রাগতেন, আর রাগার সিনে হাসতেন। হাতে কাজ না পেলে অকাজেই কাটত তাঁর অধিকাংশ সময়। শ্যুটিং-এর আগে একবার হাতে পাওয়া গেল পাঁচদিন। তিনি ভাবলেন চুল নিয়ে একটা পরীক্ষা করাই যায়। মাথার দুধারে চুলের স্টাইলের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়ে থামলেন তখনই, যখন মাথায় আর একটাও চুল অবশিষ্ট রইল না। তা দেখে পরিচালকের মাথায় হাত। এইভাবেই তাঁর কীর্তি কলাপ তাঁকে করে তুলেছিল সকলের থেকে ভিন্ন। 

হাসির মোড়কে মোড়া কিশোর কুমার ব্যক্তিগতভাবেও ছিলেন সকলের থেকে অনেকটা দূরে। মানুষকে বিশ্বাস করাটা তাঁর কাছে ছিল এক কথায় কষ্টসাধ্য বিষয়। তাই শেষ বয়সে গাছের সঙ্গে কথা বলেই মনের ভাব প্রকাশ করতেন তিনি। তাঁদের আবার ছিল আলাদা নামও। তিনিই কিশোর কুমার, যিনি অচীরেই নিজেকে ভেঙে গড়ার পাঠ নিয়েছিলেন, বারে বারে ভাঙতে সেই সকল মানুষের জন্য যাঁরা একটা সময় তাঁর জীবনের চোখের জলের কারণ ছিল, আর গড়তেন নিজেকে কোটি কোটি ভক্তের ভালোবাসায়। তাঁরই কণ্ঠে সেই সোনা ঝরা দিনগুলি ভারতীয় সঙ্গীত জগতের ইতিহাস, তাই কিশোর কুমারের জন্মদিনের উপহারের যোগানও তিনি নিজেই। অবলীলা ক্রমে গেয়ে ফেলেছিলেন- 'হ্যাপি বার্থ ডে টু মি'।